A SELF PORTRAIT: নিজের মুখের ছবি

A self portrait: নিজের মুখের ছবি
এই হয় সমস্যা। নিজের কথা বলতে গেলে কলমই সরে না। বেজায় মুশকিলে পড়তে হয়। কোথা থেকে শুরু করি, কী বলি, কিছুই ভেবে উঠতে পারি না।
ছিয়াত্তরের নভেম্বরে আমার জন্ম। এই কলকাতায়। তারপর থেকে কলকাতাটা আর আমার পিছু ছাড়েনি। উল্টোটাও সত্যি। আমিও কুয়োর ব্যাঙের মত এই শহরটার অলিগলি গুলোকেই আমার দিগন্ত বানিয়ে রেখেছি।
এক্কেবারে ছোটবেলার কিছু কিছু কথা ছেঁড়া ছেঁড়া ছবির মত ক’রে মনে পড়ে। কিছু আবার বড়দের কাছ থেকে পরে শুনেছি।
সবে কথা বলতে শিখেছি তখন। আমার কান্নার নাকি বিশেষ একটা বোল ছিল। আমি নাকি থেকে থেকেই বলতাম – ‘আমার হাতে কিছু নেই; আমি কী নিয়ে থাকবো’? আর গলার শির ফুলিয়ে কাঁদতাম। বাড়ির বড়রা বোঝানোর চেষ্টা করতেন। একান্নবর্তী পরিবার ছিল আমাদের। জ্যাঠা বলতেন – ‘এই তো, তোমার হাতে আঙুল আছে’! সত্যি বলতে কী, শুধু আঙুলে আমার পোষাতো না। সর্বক্ষণ খুটুর খুটুর করার জন্যে কিছু না কিছু প্রয়োজন হয়ে পড়তো। সে প্রয়োজন আজও আমার ফুরোয়নি।
আমার ঠাকুর্দা, আমি যাঁকে দাদাভাই বলতাম; তিনি ছিলেন মিউজিশিয়ান, যদিও সঙ্গীত কে পেশা করেননি কোনও দিন। শখের মঞ্চাভিনয়ও করেছেন বলে শুনেছি। অসাধারণ বেহালা বাজতেন। লখনৌতে তিনি বাজনার দলে নিয়মিত পারফর্ম করতেন। তিনি যন্ত্রসঙ্গীতের উপযোগী কিছু মৌলিক কম্পোজিশনও করেছিলেন; তাঁর রচনাও সে অর্কেস্ট্রায় বাজতো বলে শুনেছি। আমি নিজে তো তখনও ধরাধামে আসিনি, কাজেই সে মূর্তিতে দাদাভাইকে কখনও দেখিনি। শুধু তাঁর অর্কেস্ট্রার সহশিল্পীদের ছবি দেখেছি পারিবারিক অ্যালবাম এ। তখনকার দিনে রেকর্ডিং এর ঘরোয়া বন্দোবস্ত ছিল না, কাজেই তাঁর সৃষ্ট সুর সমেত তাঁর বাজনাও তাঁরই সঙ্গে বিদায় নিয়েছে। তবে আমার শৈশবে, অর্থাত্ তাঁর বৃদ্ধাবস্থায়, তাঁকে বাজাতে আমি শুনেছি। আজও মনে আছে, দুটো সুর দাদাভাই খুব বাজাতেন। যার একটা ছিল কাজী নজরুলের ‘বল রে জবা বল’, আর অন্যটা কৃষ্ণচন্দ্র দের ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে’। দ্বিতীয়টা বেশি ক’রে মনে আছে। বিশেষ ক’রে ওই ‘কোথায় সীতা, কোথায় সীতা’ অংশটা। বাজানোর পরে গানের কথাগুলো তিনি আমাদের মুখে মুখে ব’লে দিতেন। আর ওই ‘কোথায় সীতা, কোথায় সীতা’ অংশের সুরটা কতবার যে না বুঝতে শেখা শৈশবের দিনগুলোতে মন খারাপের চোরা স্রোত ডেকে আনতো, তার হিসেব নেই।
ঠাকুমাও ছিলেন চমত্কার মানুষ। গান-বাজনার খাসতালুক বেনারস এর মেয়ে। পরে বউ হয়ে লখনৌ, মীরাট, এলহাবাদ চষে বেড়াতে হয়েছে দাদাভাই এর ডিফেন্সএ চাকরির দৌলতে। শুনেছি ইনিও নাকি পিয়ানো এবং অর্গান বাজিয়ে গান গাইতে পারতেন। এসরাজও বাজাতেন। যদিও শুনেইছি, চাক্ষুষ দেখা হয়নি। সবই এঁরা করেছেন বাংলার বাইরে থাকাকালীন। আমি শুধু ভাবি, কেন যে এঁরা বাংলায় আসতে গেলেন; বেশ তো ছিলেন।
যাই হোক, ঠাকুমা ছিলেন মজার মানুষ। গল্প বলাতে এঁর ছিল জুড়ি মেলা ভার। আজও যখন মনে পড়ে, ঠাকুমার মুখে কাশী কিম্বা লখনৌ এর গল্প শুনছি, গায়ে কাঁটা দেয়। সে কত রকম গল্প! হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গার গল্প, বাঘ বেরোনোর গল্প, ভূতের গল্প – সে সব তো ছিলই, আর ছিল একটা আশ্চর্য গল্প। সদ্য সদ্য লখনৌ শহরে এসে বিকেলবেলা ছাদে পায়চারি করতে উঠে ঠাকুমা নাকি শুনেছিলেন পাশের বাড়ির দোতলা থেকে কেউ রেয়াজ করছে। চমত্কার সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনে পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন সে কন্ঠের মালিকের নাম। আজ ঠাকুমা কে হিংসে করি; কারণ সে মালিক ছিলেন স্বয়ং গোলাম; ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান সাহেব।
আমার ছেলেবেলাকার সু, কু, সব কীর্তির সাক্ষী ছিলেন এই ঠাকুমা। নানান কিসিম এর বই পড়তে ভালবাসতেন। নিজে নিজে লেখাপড়া শিখেছিলেন। বাংলা আর ইংরিজি হাতের লেখা ছিল দেখার মত। পরিবারের আর সকলকে বিষয় ক’রে ডায়েরিতে লিখে রাখতেন সুন্দর সুন্দর কবিতা ও ছড়া। আবছা আবছা মনে পড়ছে, ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগের ছাপ আঁকা একখানি খাতা ছিল তাঁর, আর তাতে তিনি পরিবারের কয়েকজনের ফোটোগ্রাফ আঠা দিয়ে সেঁটে তার পাশে পাশে কবিতা লিখে রাখতেন। সেই কবিতা পড়লে সে ছবির স্থান-কাল-পাত্র-পাত্রী সংক্রান্ত বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য মিলতো। সে সব খাতা কোথায় কার কাছে যে প’ড়ে আছে কে জানে। এখন আফসোস হয়, এগুলো গুছিয়ে রাখার মত বুদ্ধিটুকু যদি ছেলেবেলায় থাকতো।
তখনকার দিনের মহিলাদের কতগুলো পেটেন্ট কাজ ছিল। প্রায় সব পরিবারেই এর কিছু না কিছু নমুনা মিলতো। যার একটা হল সূচীকর্ম। সুদীর্ঘ কাল ধ’রে এই অলিখিত প্রথা প্রচলিত ছিল – সেলাই ক’রে কোনও একটা ডিজাইন মোটিফ তৈরি করতেন তাঁরা, সংসার–ধর্মের চিহ্ন স্বরূপ তাঁদের দাম্পত্যের শুরুর দিকেই সেগুলো আবার বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখা হতো। সেসব সেলাইয়ের ডিজাইন এর আবার নিজস্ব একটা আঙ্গিক ছিল (যার একটা চমত্কার আভাস দেখা যায় সত্যজিত্ রায়ের আঁকা তাঁর ‘চারুলতা’ ছবির শিরোনামের হরফের মধ্যে – সৃষ্টিশীল মানুষেরা কত কিছুর মধ্যে যে সময় কে ধ’রে রাখতে জানেন!)।॰ রামতনু লাহিড়ী মশাই জানতেন কিনা জানিনা, তবে তত্কালীন বঙ্গসমাজ থেকেই ‘পতির পূন্যে সতীর পূণ্য’, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ ইত্যাদি কয়েকটি শৈশব থেকে পাখি পড়ানো পুরুষতান্ত্রিক আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছিল সেইসব সূচীকর্মের বিষয়বস্তু। এছাড়া পরিবারে ভক্তিভাবের আধিক্য থাকলে ‘যত মত তত পথ’ বা শুধু একটি ‘মা’ গোছের সেলাইকেও বাঁধানো অবস্থায় বহু গৃহস্থের দেওয়ালে ঝুলতে দেখেছে এমনকী আমার শৈশবও।
সংসারে বিশেষ আসক্ত ছিলেন না আমার ঠাকুমা। আঁচলে যাঁর চাবির গোছা দেখিনি কখনো। মাসের বাজার অথবা রান্নাঘরে তাঁর কোনও আগ্রহ ছিলনা; যা ছিল বইয়ের পাতায়। এহেন মানুষটি ঠিক ‘পতির পূন্যে’ লিখে সেলাই করতে বসবেন এমনটা ভাবা কঠিন। তবু ঠাকুমার করা দুটো সেলাইয়ের কথা এখনো মনে পড়ে। যার একটা হল, কালো সরু কাঠের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা সাদা কাপড়ে (আমি যখন দেখেছি, তখন আর সে কাপড়কে ঠিক সাদা বলা চলে না) কালো সুতো দিয়ে সেলাই করা নটরাজ এর মূর্তি। পাশে সেলাই করেই লেখা ‘প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে হে নটরাজ…’।॰ আর অন্যটা দাদাভাইয়ের ঘরে রাখা একটা বুকশেল্ফ এর ঢাকনা। রাতের আকাশের মত গাঢ় নীল, ঠাস বুনোটের একটু চকচকে কাপড়। তার ওপরে সাদা সুতোয় কয়েকটা তারা আর সূর্য… সিম্পল ভাবনা। পাশে সেলাইতে লেখা ‘এই তো তোমার আলোকধেনু / সূর্য তারা দলে দলে / কোথায় বসে বাজাও বেণু / চরাও মহা গগন তলে’। ছেলেবেলায় বহুবার আমি ঠাকুমার কাছে এই কথাগুলোর মানে জানতে চেয়ে বিব্রত করেছি। এমনকি বিস্ময়ের বশে এও জিজ্ঞেস করেছি, যে ‘আকাশে তো কই সূর্য আর তারা একসাথে দেখা যায় না’… বা ‘দলে দলে সূর্য কী করে এলো’… এখন ভাবলে অবাক হই, সেই কোন সময়ে – ঠিক ‘গিন্নি বান্নি’ নন এমন একজন মানুষ, সংসারে ‘টিপিক্যালি’ মন না থাকা একজন ভদ্রমহিলা, যাঁকে ছোট্ট বয়েসে বিয়ে হয়ে ইস্তক বরের চাকরির দৌলতে প্রবাসে প্রবাসে ঘুরতে হচ্ছে, ছেলে মেয়ে মানুষ করতে হচ্ছে, যাঁকে নিজের ঘরসংসার সাজাতে হচ্ছে, আর তার পাশাপাশি, তিনি করে চলেছেন নিজের সাধ্য মত, আপনমনের সূচীকর্মে রবীন্দ্রনাথের গানের ভিসুয়ালাইজেশন। এসব সেলাইয়ের ডিজাইনও ছিল গ্রাফিক্যালি অনেক সিম্পল এবং আধুনিক। ছবি বা তার পাশে লেখা হরফের গঠনে রজনীগন্ধা ফুল গোছের, জোর ক’রে সুন্দর করবার মার্কামারা সেকেলে প্রচেষ্টাটা ছিলনা।
আমি আজ অবধি আর কোথাও এমন অনুচ্চারিত প্রত্যাখ্যানের ভাষা পড়িনি… এই ছিলেন আমার ঠাকুমা।
এ হেন ঠাকুমা আর দাদাভাই কে আমি আশৈশব তো বটেই, এমন কী কৈশোর অবধি পেয়েছি। যখন মানুষের ধারনা গ’ড়ে ওঠে, সেই বয়েসটাতে আমি এঁদের থেকে সক্রিয় ইন্ধন পেয়েছি। কাজেই আমার নিজের সম্পর্কে লিখতে গেলে এঁদের ছাড়া আর কার কথা লিখব?
বাবারা ছিলেন চার ভাই, পাঁচ বোন। বড় বোন রেবা ছোটবেলায় মারা যান। তাঁর পরের বোন ছিলেন সেবা; তাঁকেই সকলে বড়দি ব’লে জানত। ঠাকুমার থেকেও এঁর স্নেহপূর্ণ অভিভাবকত্বেই মানুষ হয়েছিলেন আমার বাবা কাকা পিসিরা। এই সেবা, অর্থাত্ আমার বড়পিসি, ছিলেন শখের অভিনেত্রী। মনে আছে, ছেলেবেলায় ‘মিস্টার কাকাতুয়া’ নাটকের প্রধান চরিত্রে তাঁর অভিনয় আমাদের মধ্যে চর্চার একটা অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল। বাড়ির ভেতরে ওঁদের প্রজন্মের কাউকে কোনদিন গান-বাজনা করতে শুনিনি। তবে ছোটকাকার মুখে শুনেছি জ্যাঠার নাকি একটা Hohner – এর ক্রোম্যাটিক হারমোনিকা ছিল। কোনদিন সেটা দেখিওনি। ছোটকাকার মতে, যেটার পেতলের তৈরি ‘স্লাইডার বাটন’টা নাকি দেখতে ছিল ‘প্রাইমাস’ স্টোভের পাম্পের হাতলের মত! (এখন বললে কাকা হাসবেন, কিন্তু না ব’লে পারছি না, ধন্যি কল্পনা!)।॰ খালি মনে পড়ে, খুব ছোটবেলায় – সেজো কাকাকে একবার বাঁশের বাঁশীতে ফুঁ দিয়ে সা রে গা মা বাজাতে শুনেছিলাম।
ক্লাস ফাইভ এ উঠবো উঠবো করছি, মা নিয়ে চললেন ছেলেকে গান শেখাবেন বলে। যাঁর কাছে নিয়ে গেছিলেন তাঁর নাম আর করছি না; মা যখন আমায় নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন, তিনি তখন দোতলার একটি ঘরে ব’সে গান শেখাচ্ছিলেন। আমার বেশ মনে আছে: রবীন্দ্রনাথের গান – ‘আমার সকল রসের ধারা’। আর শিখছিলেন যাঁরা, তাঁরা সকলেই দেখলাম আমার মত ছোট্ট মানুষ। তবু, কেন জানিনা সেই গানের ক্লাসের আবহটা আমার ভাল লাগেনি সেদিন। কেমনধারা পড়া মুখস্থর মত ক’রে সবাই একসঙ্গে গেয়ে উঠছিলেন ‘ছড়িয়ে পড়া আশাগুলি’ – ইত্যাদি ইত্যাদি… সে ধারায় আর যাই থাকুক রস ছিল না।
দুম ক’রে আমরা এসে পড়াতে, শিক্ষিকা দেখলাম শিক্ষার্থীদের কিছুক্ষনের বিরাম দিলেন, এবং আমায় নিয়ে পড়লেন। হারমোনিয়ামের চাবি টিপে টিপে আমার কচি গলায় সুর লাগাতে বললেন। মধ্য সপ্তকের পঞ্চমের পরের সুরগুলো সব এবড়ো খেবড়ো হয়ে গেল। ঠিকমত লাগলো না। বেশ মনে পড়ে, তিনি গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে মা কে বলেছিলেন – ‘হয়ে যাবে’।
হয়নি। কেননা, গান আমি আর শিখতে যাইনি জীবনে। এ ঘটনার কিছুদিন পরেই বাবা গত হলেন। তারও বেশ কিছুটা পরে শুরু করেছিলাম তবলা শিখতে। তাল জিনিসটা বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। তবলা শিখতাম ভানুমামার তত্বাবধানে। সুর-রসিক মানুষ ছিলেন। শুধু মাত্র আগের দিনের টাস্ক বাজিয়ে শুনিয়ে, নতুন বোল খাতায় টুকে নিয়ে ক্লাসের দায় সারা হতো না। আমার রবিবারগুলো প্রায় পুরোটাই কাটতো রবীন্দ্রনাথ-এর গান সঙ্গে নিয়ে। কী ভাবে স্বরলিপি একটা গান হয়ে ওঠে এখানেই প্রথম সেটা চাক্ষুষ করি। নানান মানুষ, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন (আমার নিজের বড়মামাও থাকতেন সে দলে), সেখানে একত্রে ব’সে অভ্যেস করতেন। ভানুমামা কখনো কখনো আমাকেও বলতেন তাঁদের সাথে সঙ্গত করতে। এই অধ্যায়টা বছর চার পাঁচ চলেছিল। গাইয়েরা কে কেমন ছিলেন সে বিশদ এ যাচ্ছি না, কিন্তু আমার সুযোগ হতো গানগুলোকে ঘনিষ্ঠ ভাবে জানার, সুরগুলোকে কচি মনে নিজের মত ক’রে নিরীক্ষণ করার। সে দেখতে শেখার ভেতরে কোনও জোর ক’রে শিখিয়ে দেওয়ার স্কুলিং ছিল না; ছিল অপরিসীম আনন্দ। ভাগ্যিস!
তার মানে কিন্তু এই নয়, যে একমাত্র রবীন্দ্রনাথই ছিলেন আমার ছেলেবেলা জুড়ে। সব ধরনের গানের ছিল অবাধ গতি। বাড়িতে কেউ আর নিয়মিত গানবাজনা করতেন না বটে, কিন্তু মা’র দৌলতে গান শুনতে পেরেছি প্রচুর। মামাবাড়ি ছিল হাঁটা দূরত্বে, আর আমার স্কুলের পাড়াতেই। নিয়ম ক’রে তাই ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, রোজ সেখানে যেতে হতো। অনিচ্ছের কারণ আর কিছুই না, মামাবাড়িতে দিদার ছিল নিয়মের কড়া অনুশাসন, দুপুরবেলায় ঘুমোতে হতো! যা আমার পছন্দের ছিল না কোনও দিন। চোখ বন্ধ করে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতাম। সে যাই হোক, মামাবাড়িতে ছিল এইচ এম ভি’র একটা রেকর্ড প্লেয়ার; আর আমার মা নানান ধরনের ইপি এবং এলপি রেকর্ড কিনে নিয়ে গিয়ে সেখানে জড়ো করতেন। বড়মামার নিজস্ব সংগ্রহ তো ছিলই। সব মিলিয়ে সংগীতের হিসেবে, ব্যবস্থা ছিল ভালই।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল তাই বলি; সে সব রেকর্ড এর প্রচ্ছদও ছিল দেখার মত। কী টাইপোগ্রাফী, কী ক্যালিগ্রাফী, কী গ্রাফিক্স – দারুন সব শিল্পকর্ম ছড়িয়ে থাকতো রেকর্ড এর প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে। এখনো চোখের সামনে ভাসে, যেভাবে কালো ব্যাকগ্রাউণ্ড এর ওপরে পোস্টাল স্ট্যাম্প এর আভাস রেখে ‘লিজেণ্ড অফ গ্লোরি’ অ্যালবাম – এর (সলিল চৌধুরির সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া সেই ‘রানার’, ‘পাল্কীর গান’ – যেটাতে ছিল) কভার ডিজাইন করা হয়েছিল, সেটা ছিল একটা স্বতন্ত্র ‘ওয়ার্ক অফ আর্ট’। আমার নিজের বিশ্বাস, ক্যাসেট এর প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রচ্ছদশিল্পের পরিধিও কভারের আকারের সমানুপাতে ছোট হয়ে গিয়েছিল। আজ যদিও সিডি-ডিভিডির দৌলতে প্রচ্ছদের আকার ফের খানিকটা বেড়েছে, কিন্তু শিল্পের মানেটা বোধহয় ততদিনে পাকাপাকি ভাবে আর্ট থেকে ইনডাস্ট্রিই হয়ে গেছে।
রেকর্ড এর পাশাপাশি ক্যাসেট চ’লে এল দেখতে দেখতে। আমাদের বাড়িতে এল ক্যাসেট প্লেয়ার। মনে আছে, ফিলিপস কোম্পানীর একটা লম্বা ক্যাসেট প্লেয়ার কিনেছিলেন সেজকাকা। সেটা ছিল আমার আর আমার খুড়তুতো ভাই টিঙ্কুর নিত্যদিনের সঙ্গী। মা কিনে আনতেন নানান বাংলা গানের ক্যাসেট, আর সেজোকাকা আনতেন বাংলা পল্লীগীতি, অসমীয়া বিহু গান, হিন্দী আর ইংরিজি গানের সংকলন।
রেকর্ড-ক্যাসেট এর পাশাপাশি আর একটা গান শোনার যন্ত্র ছিল, যেটা ছিল একান্তই আমার ব্যক্তিগত। অন্তত ততদিন পর্যন্ত তো বটেই, যতদিন না সে যন্ত্রের ব্যবহারিক দিকটা ছাপিয়ে যান্ত্রিক দিকটাতে আমার আগ্রহ গিয়ে পৌঁছতে পেরেছিল। আমার উত্সুক অধ্যবসায় যাকে চিরকালের জন্যে চুপ করিয়ে দিয়েছিল, সেটা ছিল একটা ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিও। বাবা কিনে এনে দিয়েছিলেন সেটা। আকাশবানীর কলকাতা ক, খ, আর বিবিধ ভারতীর সাথে সেখানেই আলাপ। আর অল্প আলাপেই গড়ে উঠেছিল বন্ধুতা। সেও কিন্তু আমাকে কম গান শোনায়নি। শুধু কি গান? ফুটবল? অজয় বসু খেলার মাঠটাকে যেন চোখের সামনে এনে হাজির করতেন। বাংলায় তেমন ধারাবিবরণী আর কে দিতে পেরেছে? এত ভাল লাগতো, যে পারলে উয়াড়ির সাথে সোনালী শিবিরের খেলার রিলেও শুনতে ছাড়তাম না! কানে রেডিও চেপে বসে আমার সবচাইতে প্রিয় বাঙালি খেলোয়াড় কৃশানু দে’র বাঁ পায়ের ইনসাইড-আউটসাইড ড্রিবল, তাঁর বর্ণনার ওঠা পড়ায় আমাকেও দুলিয়ে দিত যেন। ভাস্কর গাঙ্গুলী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুদীপ চ্যাটার্জী, মঈদুল ইসলাম, বিকাশ পাঁজী… এই নামগুলোর মাঝখানে ছুটোছুটি করতো কালো পেণ্টাগনাল আর সাদা মৌচাকের মত হেক্সাগনাল খোপ কাটা গোলাকার একটা চামড়ার থলে। সে মৌচাকের মধু একবার যে খেয়েছে সেই জানে কী তার নেশা। অজয় বসুর কন্ঠে আমার ছেলেবেলার দিনগুলোকে লাল-হলুদ রঙে সাজিয়ে রেখেছিল আমার ট্রানজিস্টার।
আকাশবানীর এই মিডিয়াম ওয়েভ স্টেশনগুলো ছাড়াও তাতে ধরা দিত শর্ট ওয়েভ। আর তাতে, দুটো স্টেশনের মাঝখানে লাল কাঁটাটাকে নিয়ে যাতায়াত করলে ‘চুঁউউউউউউইইইইইইই’ করে যে বিচিত্র শব্দ হতো, বলা বাহুল্য, তাতেও আমার আগ্রহ কিছু মাত্রায় কম ছিল না।
মায়ের প্রিয় শিল্পী ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কাজেই তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান, বেসিক বাংলা গান আর ছায়াছবির গানের সংগ্রহ ছিল প্রচুর। বুঝে হোক, না বুঝে হোক, হেমন্তবাবুর কণ্ঠটি আমার কানে ঢোকেনি, এমন দিন আমার ছেলেবেলায় খুব একটা আসেনি।
হেমন্তবাবুর গান সংক্রান্ত খুব ছোটবেলার একটা স্মৃতি আছে আমার বাবাকে জড়িয়ে। আমার মোটা গোঁফওলা, ডিফেন্স এ চাকরি করা বাবা ছিলেন সোজাসাপটা লোক। আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিল না তেমন। কিন্তু যেটা ছিল, সেটা হল খুব নিরুচ্চারী একটা সেন্স অফ হিউমার। মা কে কিছুটা খেপানোর জন্যে ‘মেঘের স্বপন দেখি মরুতে বাঁধিয়া বাসা’ গানটা হ’লেই বলতেন, ‘ছেলেরাও যে কাঁদতে পারে, এ গানটা না শুনলে জানা হতো না’।॰ বড় হয়ে ভেবে দেখেছি, সত্যিই স্মার্টনেসের বিপুল খামতি ছিল সে সময়ের অনেক গানেই। যে হেমন্তবাবু ‘মরি হায় চলে যায়’ এর মত আধুনিক স্মার্ট উচ্চারণ করতে পারেন, ‘মেঘের স্বপন দেখি’ সেখানে সত্যিই তাঁর কন্ঠের অপব্যবহার।
এছাড়াও ছিলেন শ্যামল মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, কিশোরকুমার, মহম্মদ রফি, গীতা দত্ত, লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, তালাত মাহমুদ – কত নাম করব? সকলেই শুনেছেন এঁদের গান। আমিও শুনেছি। তবে খুব ছোটবেলায় আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, হেমন্তবাবুর কণ্ঠস্বরই হল ভাল গলার বেঞ্চমার্ক। অর্থাত্ মানুষের গলা এর চাইতে ভাল হওয়া কোনও মতেই সম্ভব নয়।
কাম সেপ্টেম্বর, টাকিলা, দোজ ওয়ার দি ডে’জ, হাউস অব ব্যাম্বু ডোর, নেভার অন সানডে, কনগ্রাচুলেশন, ব্যাচেলর বয়, এসবও কিন্তু শুনছি এবং ভালবাসছি একই সঙ্গে। নিয়মিত ভাল ভাল ক্যাসেট কিনে এনে শোনাচ্ছেন আমার সেজোকাকা। বনি এম, ম্যান মেশিন – এসবগুলোকেও আমার ছোটবেলার থেকে বাদ দিয়ে ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
গণসংগীত শুনছি, নানান কয়ার এর গান শুনছি মেজো পিসেমশাই এর দৌলতে। তিনি রুমা গুহঠাকুরতার ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়ার’ এ গাইতেন। বাড়িতে তিনি এলেই জমে যেত। ভরাট ব্যারিটোন গলায় গোয়ার লোকগান শোনাতেন। মানে বুঝতাম না, কিন্তু এটা বুঝতাম, যে এরকম সুর আর ছন্দে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ বাংলা গানে নেই। বাংলা গানের মেজাজ একটু সিরিয়াস। এছাড়া ক্যাসেটে সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস শুনছি – ‘জন হেনরি’র হাতুড়ির কথা ভেবে ছোট্ট মাথায় অবাক হচ্ছি। একটা মানুষের কতখানি ‘পৌরুষ’ থাকলে সে স্টীম ড্রীল এর সাথে হাতে হাতে পাল্লা দেবার কথা আদৌ ভাবতে পারে! আবার এটাও ভাবছি, ‘লোকটা সারাটা গানের সব কথার শেষে বিসর্গ দিয়ে গাইছে কেন’? যেমন, ‘নাম তার ছিল জন হেনরিঃ’ বা ‘সাদা সরদার বলে হেঁকে হেঁকেঃ’। ভূপেন হাজারিকা শুনছি। তখনও ‘ওল্ড ম্যান রিভার’ এর সাথে পরিচিত হইনি, কিন্তু ‘পল রবসন’ কে জানি গানের কথা হিসেবে! পছন্দ অপছন্দ তৈরি হয়েছে অনেক পরে; তখন ছিল খালি আনন্দ করে শোনার দিন। যদিও কাউকে ‘নিগ্রো ভাই আমার’ বলে সম্বোধন করাটা ভাল লাগতো না কোনও দিনই। এভাবে কেউ কাউকে ডাকে?
আমাদের পরিবারে কেউ কোনও দলীয় রাজনীতি করেননি কখনো। দাদাভাই পুরোনো মানুষ, মনে মনে হয়ত একটু কংগ্রেসী ছিলেনওবা, কিন্তু পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক কোনও বিষয় নিয়ে সেভাবে আলোচনা করতেন না কেউ, বই নিয়ে কিন্তু তুমুল আলোচনা আর তর্ক বিতর্ক হতে দেখেছি বাবা কাকা ঠাকুমার মধ্যে। অথচ গণসংগীত কিন্তু বাজতো! আশ্চর্য সুখের কথা এই, যে সেগুলোকে কোনও ‘মতাদর্শের গান’ হিসেবে ভাবতে শেখায়নি কেউ কখনো। সঙ্গীত হিসেবেই শুনেছি এবং আমোদিত হয়েছি। বই পাগল পরিবারে রাশিয়া থেকে বই আর পত্র পত্রিকা আসতো প্রচুর। সে সব কিন্তু গোগ্রাসে পড়তাম। যেগুলোর বেশীরভাগেরই জন্ম সম্ভবতঃ রাদুগা প্রকাশন থেকে। আর প্রধান অনুবাদকের নামটা… এখনো মনে আছে – ননী ভৌমিক। মনে আছে সোভিয়েত দেশ এবং সোভিয়েত নারী বলে দুটো পত্রিকা ছিল। মস্কো থেকে আসতো, অথচ বাংলায় ছাপা! সুন্দর কাগজে সুন্দর সুন্দর ছবি, ইলাস্ট্রেশন, আর দুর্দান্ত ছাপা। ছোটদের জন্যে তাতে কমিক স্ট্রিপও থাকতো, যার তিনটে চরিত্রের কথা এখনো ভুলিনি। পোতাপ ভাল্লুক, লারিস্কা শেয়াল, আর দিমকা কাক! ছেলেবেলা কত আশ্চর্য জিনিস, না?
আর শুনেছিলাম কবিতা। কাজী সব্যসাচী। ফল হয়েছিল মারাত্মক। গোঁফ গজাতে তখনো অনেক দেরি, এদিকে সকলের অলক্ষ্যে টেপ রেকর্ডার এর চাবি টিপে রেকর্ড করে চলেছি – ‘আমি হাম্বীর আমি ছায়ানট আমি হিন্দোল, আমি চল চঞ্চল ঠমকি ছমকি, পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি, ফিং দিয়া দিই তিন দোল। আমি চপলা চপল হিন্দোল’। আইডল বলতে যা বোঝায় আর কী! হচ্ছে যে না – কে বোঝায়! পরে শুনেছি, আমি একা নই, সব্যসাচীর কণ্ঠ শুনে আমাদের ঠিক আগের প্রজন্মের অনেকেরই নাকি একই দশা হয়েছিল।
তবে এ যদি আমার ছেলেমানুষি হয়ে থাকে, এর বুড়োমানুষির দিকও একটা ছিল। শব্দকে ভালবেসে ফেলেছিলাম সেই প্রথম, ভালবেসেছিলাম ছন্দকে। আর একটা অমোঘ মন্ত্র যেন আমার মাথার ভেতরে পুরে দিয়েছিল কাজী সব্যসাচীর জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর; ‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’…
মনের কথা শুনেই যে বেঁচে রয়েছি আজও!
শুনেছি। যা পেরেছি শুনেছি। যেভাবে পেরেছি শুনেছি। সব ভাল ভাল জিনিস। মা নিয়ে যেতেন, দুই ভাইয়ের হাত ধরে। কত জলসায় যে গেছি, কাকে কাকে যে শুনেছি… হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সংগীতাচার্য পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, যামিনী গাঙ্গুলী, ভি বলসারা, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় – কত নাম করব। দু কান ধন্য হয়ে গেছে। নীলাদ্রিশেখর বসুর আবৃত্তি শুনতে গেছি। অমন গলা! অমন বাচনভঙ্গী! অথচ কেউ আর তাঁর নাম করে না। আশ্চর্য! মনেই হয় না আর, যে ওই নামে আদপেই কোনওদিন কেউ ছিলেন, আর চমত্কার আবৃত্তি করতেন।
সে সব জলসার কথা কোনদিন ভুলবো না। এসব স্মৃতি আমার আশ্রয়। এখনও চোখের সামনে ভাসে, আর ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। মহাজাতি সদনে কোনও এক রবিবারের সকালবেলা। দর্শকাসনে আমার জায়গা হয়েছে মা’র দৌলতে। মঞ্চে তখন যুগলবন্দী বাজবে। সংগীতাচার্য পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ আছেন হারমোনিয়াম এ। আর পিয়ানোতে বসেছেন স্বয়ং শ্রী ভি বালসারা। বালসারাজির পিয়ানোটা ছিল এমন ভাবে রাখা, তিনি বসলে তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছিল না। দর্শকদের থেকে আওয়াজ উঠল, ‘আপনার মুখ দেখতে চাই’। সুভদ্র এবং সুরসিক বালসারাজি বিনীত ভাবে বললেন, ‘আমাকে তো দেখতে সুন্দর না, কী আর দেখবেন, আমিই না হয় দেখিয়ে দিচ্ছি’।॰ প্রেক্ষাগৃহে হাসির রোল উঠল। শুরু হল বাজনা। নট ভৈরব। দুজনের মাঝখানে বসে আছেন শ্রী যামিনী গাঙ্গুলী মশাই। যিনি আবার দেখছি সংগীতচার্য কে মাঝে মাঝেই ইশারা করে বলছেন বাজনা সংক্ষিপ্ত করতে, বালসারাজি কে আরও স্পেস দিতে। তবলায় আছেন শ্রী মল্লার ঘোষ। পিয়ানো তে কী রকম আনন্দ বসত করে, সেটা বালসারাজি সেদিন সত্যিই দেখিয়ে দিয়েছিলেন বটে! সময়ের হিসেবে যেটা ছিল নেহাতই একটা সকাল, স্মৃতির হিসেবে হয়ে দাঁড়াল আমার বাকী জীবনটা।
দেখতে দেখতে স্টিরিও ক্যাসেট প্লেয়ারও মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে চলে এল। আমার মায়ের উত্সাহে সেও চলে এল আমাদের বাড়িতে। আর আমরা দুভাই শুনতে থাকলাম নানান গান। শুধু কী গান? সঙ্গে বাজনাও। মনে আছে, সেজোকাকা এনেছিলেন এইচএমভি শারদ অর্ঘ্য সিরিজের একটা ক্যাসেট, যার এক পিঠে ছিল কাজী অরিন্দম এর বাজানো ইলেকট্রিক গিটার এ হিন্দী গানের সুর। আর অন্য পিঠে সৈকত মুখোপাধ্যায়ের বাজানো মাউথ অর্গানে হিন্দী গানের সুর। যে মাউথ অর্গান যন্ত্রটা বাবা বেঁচে থাকতে খেলনা হিসেবে তাঁর কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম, সেটা দিয়ে এরকম সুর ও বাজানো সম্ভব!
সেই ছিল আমার প্রথম শোনা, আর ছোট্ট একটা যন্ত্রকে ঘিরে অপার বিস্ময়ের শুরু।
দ্বিতীয় বার শুনলাম টিভি তে। সেজকাকা একদিন ডেকে শোনালেন, টিভিতে সৈকত মুখোপাধ্যায় বাজাচ্ছেন। তখন আমার সেভাবে নাম-পরিচয় মনে রাখার বয়েস নয়। খালি মনে আছে, হাঁ করে শুনেছিলাম, আর কাকাকে বলেছিলাম – ‘এ তো সেই ক্যাসেটের লোকটা!’
এর অনেক পরে, তখন আমরা ১৮ নম্বর মল রোডের কোয়ার্টার্সে চলে এসেছি। ক্লাস সেভেন এর শেষ দিকে কিম্বা এইট এর শুরুর দিকে হবে। চীনে কোম্পানী ‘টাওয়ার’ – এর একটা ক্রোম্যাটিক হারমোনিকা কিনে দিয়েছেন মা। ততদিনে এটা বুঝে গিয়েছি, না শিখে এ জিনিস বাজানো সম্ভব না। কেননা কানে লেগে রয়েছে ‘ক্যাসেটের সেই লোকটা’র বাজনা। ও রকম হতে হবে তো! ভাবছি কার কাছে শেখা যায়, এমন সময়ে প্রতিবেশী এক দাদার কাছে শুনলাম কামারহাটিতে নাকি এক ভদ্রলোক থাকেন, যিনি হারমোনিকা বাজান এবং শেখানও বটে। কামারহাটি আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূর। তবু একরকম ঝোঁকের মাথাতেই সে দাদার হাত ধ’রে চ’লে গেলাম তাঁর বাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে বসলাম। তিনি আসবেন ঘরে। আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে তাঁর জন্যে। সোফায় ব’সে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি, চোখ চ’লে গেল দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে। হাতে আঁকা। গাঢ় বাদামি প্যাস্টেল পেপার এর ওপরে ড্রাই প্যাস্টেলে হালকা রঙ চাপিয়ে চাপিয়ে আঁকা তাঁর একটা প্রতিকৃতি। শিরদাঁড়ায় একটা শিহরণ খেলে গেল। ক্যাসেটের সেই লোকটা!
‘ক্যাসেটের সেই লোকটা!’ বাড়ি ফিরে এসে মা কে বলেছিলাম কথাটা। সেই থেকেই সৈকত মুখোপাধ্যায় নামটা আমার বাকি জীবনটার সাথে জুড়ে গেল। সৈকতদা – আমার শিক্ষাগুরু। যেটুকু বাজাতে শিখেছি, তাঁর দৌলতেই তো… তাঁর কাছেই শিখেছি, কী ক’রে স্বরলিপি থেকে গান হয়ে উঠতে পারে একটা সুর।
এখান থেকে শুরু হল আমার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়। হারমোনিকা কিভাবে ধরতে হয় থেকে শুরু ক’রে কিভাবে নোটেশন পড়তে হয়, লিখতে হয় সবই তাঁর কাছে শেখা। কী ক’রে জানি না, তবে সা রে গা মা – টা আগে থেকেই জানতাম, ফলে সুবিধে হয়ে গেছিল একটু। একটা স্বাভাবিক টান ছিলই, শিখতে গিয়ে আরও ভালবেসে ফেললাম যন্ত্রটাকে। অনেক সময় দিতে লাগলাম। দিনে পাঁচ থেকে ছ ঘণ্টা রেয়াজ করেছি সে সব দিনগুলোতে। পড়াশুনো ভাল লাগতো না। পড়ার বইয়ের সাথে হারমোনিকা নিয়ে বসতাম। দু পাতা পড়ি তো পনেরো মিনিট বাজিয়ে নিই।
বড়মামা যেহেতু রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, তাঁর ছিল স্বরবিতানের সমস্ত খন্ড; আর আমার ছিল রবীন্দ্রনাথের সুরের প্রতি স্বভাব দুর্বলতা। কাজেই সৈকত দা’র লিখে দেওয়া হোম টাস্ক এর বাইরেও কোনও দিন হোম টাস্ক এর অভাব হয়নি আমার। এই ক’রে ক’রে স্বরলিপি জিনিসটার সাথে এক অদ্ভূত আত্মীয়তা গ’ড়ে উঠেছিল।
আর ওই বয়েসেই লক্ষ্য করছি, যে সৈকতদা শ্রী মিলন গুপ্তর (যাঁকে ভারতবর্ষে হারমোনিকা যন্ত্রটির প্রচার এবং প্রসারের একমাত্র কাণ্ডারী বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। উত্সাহীরা যাঁকে ভারতের ল্যারি অ্যাডলারও বলে থাকেন।) একজন সুযোগ্য ছাত্র হওয়া সত্বেও বাজনায় নিজের স্বতন্ত্রতা এবং স্বকীয়তা ধ’রে রাখছেন কী ভাবে। শেখার চেষ্টা করছি। স্টাইলটা নয়, অ্যাপ্রোচটা। মনে মনে ভাবতাম, আর যাই করি, আমি কোনদিন নকল করব না। সৈকতদারও নয়, মিলনদারও নয়। আমাকে আমার বুদ্ধি দিয়ে আমার মত ক’রে একটা গান কে বুঝতে হবে, যদি সেটাকে নিজের ভঙ্গিতে প্রকাশ করতে হয়। দুজনের কাছ থেকেই প্রত্যক্ষে এবং পরোক্ষে অনেক খুঁটিনাটি শেখার চেষ্টা করলেও আজ পর্যন্ত নকল করার চেষ্টা আমি করিনি।
তখনও বেশিদিন হয়নি সৈকতদার বাড়িতে যাচ্ছি; আমাকে সৈকতদা বসতে বলতেন, অন্যান্য ছাত্রদের ছেড়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে পড়তেন। একদিন আগের দিনের টাস্ক বাজিয়ে শোনাচ্ছি, রবীন্দ্রনাথের ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা ক’র প্রভু’। সৈকতদা শুনলেন, আমাকে আর একবার বাজাতে বললেন। আমি বাজালাম। তারপর তিনি পাশের ঘর থেকে তাঁর ছোড়দাকে ডেকে আনলেন শোনানোর জন্যে। আবার বাজাতে হল। ছোড়দার চোখের কোনে তারিফ। বুঝতে পারলাম যাঁকে শোনাচ্ছি, মনে ধরছে তাঁর।
এর বেশ কিছু পরের ঘটনা। আমেরিকা থেকে আমার এক দাদু এসেছেন… একথাটা বলার আগে আমার এই দাদুটিকে নিয়ে দু কথা বলে নিই। আমার ঠাকুমার ছোটভাই, শ্রী অভয়পদ ঘোষ। দেরাদূনএ থাকতেন। পরবর্তীতে আমেরিকা চলে যান, এবং শেষ জীবনটা সেখানেই কাটান। মাঝে মধ্যে কলকাতায় আসতেন। আর এলে আমাদের বাসাতেই উঠতেন। সত্যি কথা বলতে এঁকে একটু ভয়ই করতাম। ভয়ের কারণ আর কিছুই না, ধ’রে ধ’রে পেঁপে খাওয়াতেন (কোনরকমে কোঁত্ ক’রে যখন গিলে ফেলতাম, হেসে বলতেন, “জানিস, আমি নিজেও পেঁপে খাইনা!”), রবীন্দ্রনাথ ছাড়া দশজন বাঙালি কবির নাম জিজ্ঞেস করতেন; আর বলার সময় এক দুই ক’রে গুনতেন, পিঠ চুলকে দিতে বলতেন, গা টেপাতেন ইত্যাদি ইত্যাদি। যাই হোক, সেবার তিনি আসাতে বাজনা শোনানোর হুকুম হল। আমেরিকা প্রবাসী মানুষ, দিশি সুর কী আর পছন্দ করবেন? এসব ভেবে-টেবে আমি বাজাতে শুরু করলাম। ডক্টর জিভাগো ছবির বিখ্যাত সেই লারা’স থিম। যখন বাজাই (যদি না নোটেশন সামনে থাকে), প্রায়ই আমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যায়। এখনও হয়, সেদিনও হয়েছিল। চোখ খুলেছিলাম বাজনা শেষ হবার পরে। দেখলাম, দাদুর চোখ চিক চিক করছে; ভ’রে গিয়েছে জলে। তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে দাদু কেঁদে ফেলেছেন কখন। হারমোনিকার মত একটা চীয়ারফুল ইন্সট্রুমেন্টও তাহলে চোখে জল আনতে পারে?
সেদিন রাত্রে শুতে যাবার সময় ভেবেছিলাম, ‘পারছি তাহলে! মানুষের আবেগ কে ছুঁতে পারছি!’ আর এখন ভাবছি, অন্যের চোখের জলে আনন্দ পাওয়া, এ শুধু পারফরমার হতে চাওয়া আহাম্মকদের পক্ষেই সম্ভব!
আগেই বলেছি, হাতে আমার সব সময় কিছু না কিছু থাকতে লাগতো। না হলেই বড্ড একা লাগতো। যা আমার এখনো লাগে। কিছু না হলে অন্তত একটা লেখার খাতা। লেখার অভ্যেসটা বোধহয় ঠাকুমার থেকেই পাওয়া। এক্কেবারে ছোটবেলা থেকেই আমার লেখার বাতিক ছিল। শুরু করেছিলাম গল্প লেখা দিয়ে। যেখানে যা শুনতাম, যা পড়তাম, সব চলে আসতো কলমের ডগায়। একটা হাতে লেখা বই ও বানিয়েছিলাম। যার নামটা শুনলে মনে হবে বুঝি রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ুর কোনও বইয়ের শিরোনাম থেকে নেওয়া। ‘বেনারসের হানাবাড়ি’।॰ কিন্তু বাস্তবে তা ছিল না। ঠাকুমার মুখে শোনা কাশীর গল্প আর তাতে আমার চড়ানো রঙ; এই ছিল সে গল্পের বিষয়বস্তু। ইস্কুলে শুভময় নামে আমার এক সহপাঠী ছিল আমার লেখার দারুন ভক্ত। এটা লিখতে লিখতে শুভময়ের কথা মনে পড়ে গেল। এই মুহূর্তে কোথায় আছে, কেমনই বা আছে সে কে জানে। দেখা হওয়া দূরে থাক, কতকাল ওর নামটাও যে মনে আসেনি… গোলগাল ফুটবলের মত দেখতে হাসিখুশি চেহারার শুভময় খুব উত্সাহ দিত লেখার ব্যপারে। মূলত তার উত্সাহেই বেনারসের হানাবাড়ি শেষ করতে পেরেছিলাম। তাতে আবার একটা ভূমিকাও লিখেছিলাম। কৃতজ্ঞতা-টিতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি এমন কথাও সেখানে লেখাছিল, যে এ বই এর চোদ্দটা গল্পের কোনটাই আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, কাজেই আমার চোদ্দটা অপ্রকাশিত গল্পের সংকলন হল বেনারসের হানাবাড়ি!
গল্প ছাড়িয়ে আমার হাত গিয়ে পৌঁছেছিল ছড়ায়। বাড়িতে আমি ছিলাম একমাত্র ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। বাকি সবাই মোহনবাগানী। কাজেই, অস্তিত্ব জাহির করতে আমাকে বেজায় কসরত করতে হতো। একখানা খাতা করেছিলাম, যাতে মোহনবাগানের বিপক্ষে এবং ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে ছড়া আর প্যারোডি গান লিখতাম। রোজ অন্তত একটা ক’রে। মুশকিলটা হতো আমি ইস্কুলে গেলেই। আমার খাতা হয়ে যেত বেহাত, আর ফিরে দেখতাম আমার ছড়ার পাশে পাশে কাউন্টার ছড়া লেখা রয়েছে তাতে। বুঝতে অসুবিধে হতো না কাজটা কার বা কাদের। আমার সেজকাকা আর পিসতুতো দাদা (বড়পিসির ছেলে খোকাদা, আমি যাকে ছেলেবেলা থেকে ডনদাদা বলে ডেকে এসেছি)।
আমাদের ছড়া-যুদ্ধের যেটুকু মনে পড়ে তার দু-একটা নমুনা দেওয়া যাক। তখন ময়দানে পিকে ব্যানার্জী বনাম অমল দত্ত বাগযুদ্ধ চরমে; সে বছর অমল দত্ত মোহনবাগানের কোচ, আর পিকে ইস্টবেঙ্গলের। ইস্টবেঙ্গলের কাছে বড় ম্যাচে হেরে সেবার অমল দত্ত ডোপিং এর অভিযোগ এনেছিলেন। ধরা যাক, আমি লিখেছি:
“অমল দত্ত যতই চেঁচান ডোপিং ডোপিং ডোপিং
তিনি কি জানেন না পিকে কোচেদের কিং?
একটু পিকের ভোকাল টনিক
অমল দত্ত তাতেই খানিক
উত্তেজিত, তাইতো তেড়ে আসেন নেড়ে শিং!”
ইংল্যান্ড থেকে সে বছর জন ডিভাইন বলে একজন খেলোয়াড় খেলতে এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গলে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে ক’রে উঠতে পারছিলেন না। একদিন ইস্কুল থেকে ফিরে খাতা খুলে দেখি লেখা রয়েছে:
“ইংল্যান্ডের বেতো ঘোড়া ডিভাইন জন
খেলতে নেমে বলে আমার পেট করে কনকন” – ইত্যাদি ইত্যাদি!!!
যাই হোক, কবে যে কিভাবে এই ছড়া-ভূত বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিল তা আর আমার মনে নেই, কিন্তু সে ভূত আবার ফিরে এসেছিল গান হয়ে।
তখন সামান্য নোটেশন লিখতে শিখেই ইচ্ছে হয়েছিল গান লিখে তাতে সুর করি। সুর করা যে চাট্টিখানি কথা নয়, সেটা আমার মাথায় ঢোকার মত বুদ্ধি বা ম্যাচিওরিটি ছিল না। প্রথমে অন্যের লেখায় সুর করার চেষ্টা করলাম। অন্নদাশংকর রায়, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখের লেখায় সুর করার চেষ্টা করতে লাগলাম। তারপরে নিজে লেখার চেষ্টা করতে শুরু করলাম। বলা বাহুল্য, কিছুই হয়ে ওঠেনি সে সব কাজগুলো, কিন্তু চেষ্টার অন্ত ছিল না।
এখানে বলে রাখা ভাল, বিখ্যাত হবার কোনও বাসনা থেকে এসব করিনি কোনদিন, সে সব মাথাতেও আসতো না। শুধু মাত্র হাতে কিছু ‘মনের তাগিদে করবার মত কাজ’ চাই বলে, করার নেশায় চেষ্টা করে গেছি।
ইতিমধ্যে সৈকতদা বললেন আমাকে নিয়ে যাবেন মিলনদার বাড়িতে, তাঁকে আমার বাজনা শোনাবেন বলে। আমার দুর্ভাগ্য, মিলনদা এর পরে বেশিদিন পৃথিবীতে ছিলেন না, ফলে তাঁকে সামনে থেকে দেখা, সরাসরি তাঁকে শোনা বা নিজের বাজনা শোনানো কোনটাই আমার আর হয়ে ওঠেনি।
সৈকতদা হয়ত ভেবেছিলেন, আমার মধ্যে সামান্য হলেও সাংগীতিক সম্ভাবনা আছে, এবং সেটা যাতে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে, তাই আমাকে তিনি পাঠিয়েছিলেন শ্রী সমীর খাসনবিস এর কাছে গিটার শিখতে। সমীরদার মত বিরাট মাপের মানুষ সত্যি বিরল। তাঁর কাছে কিছু বিদেশী গান শেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমার দুর্ভাগ্য, কিছুদিন শিখতে না শিখতে কলেজের গন্ডী টপকে আমার চাকরী করার বেজায় দরকার হয়ে পড়ল, ক্রমে সেটাই হয়ে পড়ল মুখ্য, শেখা হল না প্রায় কিছুই।
এর অনেক পরে, ক্যালকাটা সিনে মিউজিশিয়ান্স অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সভায় সমীরদার সাথে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল একদিন, নিজস্ব উচ্চারণে সমীরদা বলছিলেন, ‘তোকেও বলছি, আমার মেয়েকেও বলি – একটা পর্যয়ের পরে তোদের আর গানবাজনা শেখা হবে না। দিনকাল বদলে গেছে, আমরা যেভাবে শিখতে পেরেছি, যতটা সময় আর নিষ্ঠা দিতে পেরেছি, সেটা তোদের পক্ষে আর সম্ভবই না। এটা তোদের দোষ না, এই সময়টাই অন্যরকম ডিমান্ড করে। সেই মেটিরিয়াল কন্ডিশনই আর নেই…’
ইতিমধ্যে বেশ কিছু গান লিখে সুর ক’রে ফেলেছি। সুর ক’রে নোটেশন লিখে রেখে দিতাম। নিজে যেহেতু গাইতে পারিনা মোটে, মনের তাগিদ নিবৃতির ওইটেই ছিল একমাত্র রাস্তা। নোটেশন গুলো চোখের সামনে দেখলে যেন কানের পাশে গানগুলো শুনতে পেতাম।
১৯৯২ সাল। এই রকম সময়ে আমার মা’র এক সহকর্মীর কাছ থেকে একটা অডিও ক্যাসেট উপহার পাই। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের তোমাকে চাই। ওইটাই চোখ খুলে দিল। পাল্টে দিল সবকিছু। গান তৈরির কিছুই যে এতদিন হয়নি, বুঝতে পারলাম। বুঝলাম, দেখতে হবে, শুনতে হবে, শিখতে হবে, চর্চা করতে হবে। আর করতে হবে পড়াশোনা। এ জিনিস এমনি হয় না।
সুমনের গান মানে আমার কাছে অনেক কিছু। এই কলকাতায় বোধহয় তাঁর এমন একক অনুষ্ঠান আজ অবধি বড় একটা হয়নি, যেখানে আমি গিয়ে উপস্থিত হইনি। ‘তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ / তার অনু পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ’ – কবীর সুমনের গানে আমি সেই আনন্দের সন্ধান পেতাম। আজও পাই।
ইতিমধ্যে আমার শহরে, আমার বাড়ির কাছেই আর এক যুবক সুর করবেন, গান গাইবেন বলে তৈরি হচ্ছিলেন। অভ্র। অভ্র ঘোষ। পেশায় স্কুল-শিক্ষক। তাঁকে আমি চিনতাম না। এদিকে মজার ঘটনা ঘটল, আমার ছেলেবেলার সেই রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষয়িত্রী, যাঁর কাছে মা নিয়ে গেছিলেন ছেলেকে গান শেখাবেন বলে, তাঁরই আয়োজিত এক বসন্ত-উত্সবের সন্ধেয় আমার ডাক পড়েছিল হারমোনিকা বাজানোর জন্যে। তখন তাও এদিক সেদিক বাজানোর জন্যে কেউ কেউ ডাকতেন। আজকাল তো আর কেউ শোনেন বলেও মনে হয় না। সেই অনুষ্ঠানে আমি আর অভ্র গেছি আলাদা আলাদা ভাবে। তিনি গেয়েছেন গান, আর আমি বাজিয়েছি হারমোনিকা। অথচ কেউ কাউকে চিনি না।
স্বর্ণেন্দু ছিলেন আমাদের কমন বন্ধু। অভ্র স্বর্ণেন্দুর কাছেই শোনেন, সুমন্ত বলে একটি ছেলে নতুন গান তৈরি করার চেষ্টা করছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমার লেখা বেশ বিদঘুটে একটা লম্বা চেহারার গান ও তার স্বরলিপি প’ড়ে সেই সন্ধেতেই ঘণ্টা দেড়েক হয়রানির পর অবশেষে বাড়ি খুঁজে পেয়ে অভ্র চ’লে আসেন আমার বাড়িতে। পরের দিন আমি তাঁর বাড়িতে। এই ভাবে বন্ধুত্বের শুরু। আমরা সিদ্ধান্ত নিই দুজনে মিলে কাজ করব। সাধারণ ভাবে আমি গান লিখি, আর অভ্র তাতে সুর করেন। কখনো কখনো দুজনে ব’সে সুর করি, আর কদাচিত্ আমি নিজে সুর করার চেষ্টা করি। সে রকম ঘটনা আর প্রায় ঘটেনা বললেই চলে। কেননা আমি নিজের অক্ষমতাটা বুঝতে শিখেছি। তা দুজনে মিলে প্রায় সাড়ে পাঁচশো – ছশো গান তৈরি করেছি এদ্দিনে। যার বেশীরভাগই ভুলে গেছি দুজনেই। আমরা এরকমই।
অনেকদিন বয়েস হয়ে গিয়েছে দুজনের বন্ধুতার। অনেক কিছুই পাল্টে গিয়েছে কলকাতাটার। আমাদের ভাবনাচিন্তারও বদল ঘটে গিয়েছে অনেক, চুলে ধরেছে পাক।
ক্রমশ একলা হতে থাকা শহরটায় মিউজিক্যালি রিলেট করা যায় এমন মানুষের সংখ্যা কমছে। যুগছুট আমরা নিজেদের মত ক’রে নিজেদের জন্যেই গানবাজনা ক’রে চলেছি।
সমীরদা বলছিলেন, মেটিরিয়াল কন্ডিশন আর নেই… অভ্র হাড়ে হাড়ে জানেন। আমিও।
২০ মার্চ ২০১১, রোববার
দমদম ক্যান্টনমেন্ট