রবি ঠাকুর ও একটি গল্পদ্য
একটু আগে একটা গান লিখেছি। বলা ভাল লিখে দিয়েছি। অনুরোধ, ফরমায়েশ বা দাবি, যে কারণেই গানটা লেখা হয়ে উঠে থাকুক না কেন, বলতে দ্বিধা নেই, যে অনেক দিন পরে একটা গান লেখায় আদপেই হাত দিলাম।
আসলে বেশ কিছু বছর আগে একটা টিভি সিরিয়ালের টাইটল সং হিসেবে একটা গান লিখে দিয়েছিলাম, যার শরীরে ছিল একটি আস্থায়ী, একটি অন্তরা আর সিরিয়ালের গানের নিয়ম মেনে একটা ধরতাই! একটু আগে যেটা লিখলাম, সেটার কন্ডিশনই ছিল এই, যে সেই সিরিয়াল-সঙ্গীত কে বেসিক-সঙ্গীত বানাতে হবে। অর্থাত্ অলরেডি হয়ে থাকা একটা সুরের কাঠামো মেনে আমাকে অন্তত আরও একটা অন্তরা লিখে দিতে হবে।
আমার কাছে চ্যালেঞ্জটা এল এইভাবে, যে শাব্দিক এবং ছান্দিক দাবিগুলো মানার পরেও, সেই সিরিয়ালের ব্র্যান্ডিং ছাপিয়ে গোটা গানটার ভেতরে একটা সাধারণ বক্তব্যের প্রকাশ ঘটাতে হবে। নইলে গানটির ‘আধুনিকত্ব প্রাপ্তি’ ঘটবে না!
সাধারণ ভাবে আমি আগে লিখি, তার ওপরে গানের সুর হয়। তবু, কোনও বিশেষ প্রয়োজনে পেশাদারী ভাবে লিখতে হলে তো চাহিদা মেনেই লিখতে হবে। তাই এই শীতকালেও প্রচুর ঘাম-টাম ঝরিয়ে, আধঘন্টার মধ্যে দিলাম লিখে। একটা নয়, আরও দুটো, অর্থাত্ মোট তিনটে অন্তরা। প্রথম অংশ, যেটা ইতিমধ্যেই লেখা ছিল, সেটাকেও সামান্য সারাই করলাম, যিনি সুরকার, তাঁকে ব’লে সেই অনুযায়ী সুরেরও সামান্য অদল-বদল করিয়ে নিলাম। সবটাই ঘটলো ফোনে ফোনে।
সুরের ওপর লিখতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়। এইভাবে গান লেখাটা আমার মনে হয় যতটা না কবিত্ব, তার চাইতে অনেক বেশি কথার ‘ক্রাফ্টসম্যানশিপ’।॰ যেখানে শব্দের ওজন, মাত্রা, অন্তর্মিল সব আগে থেকে ঠিক করা।
কৈশোরে একবার জাভেদ আখতার সাহেবের একটা ইন্টারভিউ দেখেছিলাম, টিভিতে। অন্যান্য কথার ফাঁকে তিনি বলছিলেন, সুরের ওপরে গান লিখতে গেলে একজন ফিল্মের লিরিসিস্টকে কী কী খেয়াল রাখতে হয়। একটা উদাহরণ দেখিয়ে, তিনি বললেন, ‘সুরকার যদি আমাকে একটা ফ্রেজ দিয়ে দেন – ‘টা টা টা টা | টা – – – ’; আমি কিছুতেই সেখানে ‘আজারে’ শব্দটা বসাতে পারব না। এখানে আমাকে বসাতে হবে ‘দিলনে কাহা’ বা এ জাতীয় কোনও শব্দ, যাকে মনেমনে গুনলে পাঁচ সংখ্যাটা পাওয়া যাবে। এবং সব শেষে দেখতে হবে সিচুয়েশন অনুযায়ী একটা মিনিংফুল লিরিক হিসেবে সেটা দাঁড়াচ্ছে কি না।’
অনেক মনেরাখা, অনেক ভুলে যাওয়ার মধ্যে এটা মনে থেকে গেছে।
আপাতদৃষ্টিতে অ্যাব্স্ট্রাক্ট মনে হলেও, যে কোনও লেখারই আসলে একটা গঠনগত জ্যামিতি আছে, আর তাই যে কোনও ধরনের লেখাই রীতিমতো অভ্যেসের ব্যাপার। সেই অভ্যেস থেকে কিছুদিনের জন্যেও বেরিয়ে গেলে খুব মুশকিল হয় ফের সেখানে ঢুকতে। একটা সময় সংখ্যায় প্রচুর লিখতাম। গানই লিখতাম মূলত। লেখা অভ্যেস করার জন্যে যা পেতাম তাই নিয়ে লিখতে শুরু করতাম। আর ঠিক দেখতাম একটা না একটা গান বেরিয়ে আসছে সেটা থেকে। সবই যে, (ইনফ্যাক্ট কোনটাই যে) একেবারে দারুন একটা কিছু দাঁড়াতো তেমন নয়, কিন্তু এক্কেবারে ফেলে দেবার মতও হত না বোধহয়। আমি এমনিতে লেখা অনেক কমিয়ে দিয়েছি আজকাল। লেখা কমিয়ে দিলাম… সঙ্গীত থেকে একেবারে বিচ্ছিন্নই হয়ে গেছিলাম; তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা প্র্যাকটিক্যাল কারণ হল রেপিটেশন। মনে হতে লাগলো যা লিখছি সব এক ধরনের হয়ে যাচ্ছে। মনও দিতে পারছিলাম না ঠিকভাবে। ফলে সমস্ত প্র্যাক্টিস বন্ধ। আজ হঠাত্ সুরের ওপরে কথা বসানোর কসরত্ গিয়ে নাভিশ্বাস উঠে কথা গুলো মনে হচ্ছে।
সুরের ওপরে কথা বসানো এক ধরনের প্র্যাক্টিস। যেখানে ফর্ম কন্সট্যান্ট, আর কনটেন্ট ভেরিয়েবল। এর উল্টো আর একধরনের প্র্যাক্টিস হল, প্রতিপাদ্য বিষয়টাকে গানে বা পদ্যে প্রতিষ্ঠিত করা। যেখানে কনটেন্ট কন্সট্যান্ট, আর ফর্ম ভেরিয়েবল।
দ্বিতীয় ধরনের স্কিলটা একটা সময় মোটামুটি ভালই রপ্ত করেছিলাম। যা বলতে চাইতাম, সেই অনুযায়ী ফর্ম তৈরি করে নিতাম। গানে গানে সে কথাটা বলে ফেলতে বিশেষ হিমশিম খেতে হতো না। এতদিনের অনভ্যেসে সে স্কিলটা কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটা দেখতে মন চাইছিল। ভাবলাম আজ এরকমও কিছু একটা লিখি, যার বিষয়বস্তুটা আগে থেকে আমার জানা। এখন, চাইলেই তো দুম ক’রে লেখার বিষয় ভেবে ফেলা যায়না, কেননা সেটাও একটা প্র্যাক্টিস।
বহুদিন আগে শোনা একটা রসিকতার কথা সন্ধে থেকে মনে পড়ছিল। একটা রসিকতাও তো একটা লেখার বিষয়বস্তু হতেই পারে। পারে না? সেই অনুযায়ী লিখতে লিখতে দেখলাম পদ্যের ফর্মে লেখা একটা মজার গল্প হয়ে দাঁড়াল! কী বলে ডাকা যায় এটাকে? ‘গল্পদ্য’?
লেখাটা হুবহু নিচে তুলে দিচ্ছি।
বিশু কাকু একদিন ডাকলেন, – “শোন”
এই রে! আবার পড়া ধরবে এখন!
ভাবতে ভাবতে আমি কাঁচুমাচু মুখে
কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম সামান্য ঝুঁকে।
“ঠিক করে দাঁড়া” – কাকু বলেন খেঁকিয়ে
“ফের যদি শিরদাঁড়া রাখিস বেঁকিয়ে…”
‘ঠিক করে দাঁড়া’ আর ‘শিরদাঁড়া’ মিলে
কী দাঁড়াল তাই ভেবে অবস্থা ঢিলে
হয়ে এল, তবু আমি চুপ ক’রে থাকি;
মনের ভাবনাগুলো মনে চেপে রাখি।
‘দাঁড়ি মাঝি’ ইত্যাদি মনে পড়ে যায়…
হাসি পায়, মনে পড়ে সুকুমার রায়।
হাসলে আবার যদি কাকু রেগে যান;
গম্ভীর মুখে তাই না হাসার ভান
ক’রে আমি শিরদাঁড়া রাখি সোজাসুজি,
মুখে বলি – “বলো কাকু, ডাকছিলে বুঝি?”
শুধোলেন; “হ্যাঁ রে পটা, কোন ক্লাস তোর?”
এই রে! এবার শুরু প্রশ্নের তোড়!
বুক ঠুকে বললাম – “এই তো, ফাইভ”
“বাঃ বাঃ – কে ছিলেন বলতো ক্লাইভ?”
হেসে বলি – “জানি এটা, সে তো বড়লাট!
তার ছবি ইতিহাস বইয়ের মলাট
জুড়ে আঁকা আছে” – আমি বলি টেনে টেনে;
“যদিও ‘লয়েড’ বলে লোকে বেশি চেনে”
উঠে যায় জোড়া ভুরু কপালে কাকুর
সেখানে নাচছে বুঝি ক্যালিপসো সুর
“লয়েড!! লয়েড!!!??” – তাঁর মুখ থমথম
কাকু যেন শুনলেন নামটা প্রথম!
“তোর তো দারুন জ্ঞান ইতিহাসে – পটা!
কটা ইস্টার পাস এগজামে? কটা?
এই যে বললি তুই, লয়েড না কে –
সেই যদি লর্ড হয়, ‘রবার্ট’ টা কে?”
‘রবার্ট লয়েড?’ … উঁহুঃ জমছে না ঠিক।
নামটা দাঁড়াচ্ছে না – এদিক সেদিক
তাকিয়ে ভাবতে থাকি – ‘এই রে, আবার
ভুল-টুল করিনি তো? একটু ভাবার
আগেই তড়াক করে বলে ফেলে ফেঁসে
যাইনি তো?’ তবু আমি মুখে বলি হেসে –
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো ক্রিকেটার; ইয়াব্বড় মোচ!
এখন খেলেনা আর, এখন তো কোচ।
ওই যে গো! লর্ড না কী – বললে না পরে?
ওটাই তো মাঠ; ওরা খেলাধুলো করে!”
কিছুই মাথায় আর ঢোকে না যখন
হতবাক হয়ে গিয়ে মানুষ তখন
অদ্ভূত ফ্যাল ফ্যাল ক’রে চেয়ে থাকে –
কাকুও তেমনি চান চশমার ফাঁকে।
“নাঃ আমাদের পটা হিস্ট্রির লোক;
ওর কাছে খাপ খোলা সাজে না যা হোক”
মনে মনে হেসে নিই; ‘বুঝে দেখ তবে,
এমনি এমনি শুধু ধমকালে হবে?’
“সহজ ট্রানস্লেশন, বলতো দিকিনি”
চশমাটা নাকে টেনে তুলে নেন তিনি
এইবার ভয় ভয়… “হ্যাঁচ্চঃ” (হাঁচি)
ইংরিজীতেই আমি শুধু কাঁচা আছি!
আর কত প্রশ্নের উত্তর বাকি?
ধুত্তোর! বিশুকাকু ছাড়বে না নাকি?
“‘সোলার কুকার’ – এটা তর্জমা কর”
“শুধু এটা?” – প্রাণ যেন ফিরে পেল ধড়
“হ্যাঁ হ্যাঁ, শুধু এইটুকু বাংলায় বল”
মনে মনে হাসি আমি; এ তো সোজা! জল!!
“সৌর চুল্লি?” – “উঁহু, হলনা সঠিক”
ফের ভাবি এটা সেটা এদিক সেদিক
“সৌর উনান? এটা নিশ্চয় হবে!”
“এটাও হল না, তুই বুঝে দ্যাখ তবে!”
“ভুল টা কোথায় হল? ‘সোলার’ – সৌর…
‘কুকার’ রাঁধুনি হবে?” – “দুপাক দৌড়ো”
বললেন বিশুকাকু; “খুলবে মাথাটা,
গতরের সাথে সাথে বুদ্ধিটা খাটা!”
আমাকেই পেয়েছেন ছোট্ট বেচারা…
বলে ফেলি; “হচ্ছে না এ আমার দ্বারা;
বাংলাটা বিশুকাকু বলে দাও তবে,
মা বোধহয় ভাবছেন, বাড়ি যেতে হবে”
যেই না বলেছি, আসে জবাব কাকুর
“সোলার হলেন ‘রবি’ – কুকার: ‘ঠাকুর’…”
—————————–
৬ জানুয়ারী, ২০১২।॰ শুক্রবার
দমদম ক্যান্টনমেন্ট