ও আলোর পথযাত্রী [O Alor Pathojatri]

এখানে সেখানে প’ড়ে বা বড়দের মুখে শুনে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ বললে যে ছবিটা মনের ভেতরে ভেসে ওঠে, তাতে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী তাবড় তাবড় শিল্পী ও ইন্টেলেকচুয়ালরা এসে ভিড় জমান। এ এমন ছবি, যেটা দেখতে দেখতে একদিকে বিজ্ঞ বিজ্ঞ মুখ ক’রে পৃথ্বীরাজ কাপুর থেকে শুরু ক’রে বিজন ভট্টাচার্য, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, উত্পল দত্ত, শম্ভু মিত্র, ঋত্বিক ঘটক এমন সব নামগুলোকে অনায়াসে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ ক’রে ফেলা যায়, অন্যদিকে এ ছবির আলো-ছায়া গানবাজনার মানুষ হিসেবে আমার প্রতি বিশেষ একটা আকর্ষণ রচনা করে। ছোটবেলা থেকে যাঁদের কাজ শুনেছি, ভালবেসেছি তাঁরা সকলেই প্রায় সেখানে ছিলেন যে। শুনেছি সঙ্গীত সেখানে এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল, যে শুধু মতাদর্শ নয়, স্রেফ গানবাজনার টানেই অনেকে এসে জুটেছিলেন সে দলে।

আমার ভালোবাসার সংগীতকার সলিল চৌধুরি এমন একটা নাম, যে নাম ছোটবেলা থেকে শোনা গণনাট্য আন্দোলন ব্যাপারটার সঙ্গে একেবারে একাত্ম হয়ে গেছিল। বড় হয়ে জেনেছি চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে পঞ্চাশের গোড়ার দিকে সলিলের হাত থেকে বেরোনো বেশীরভাগ কাজই ছিল সরাসরি সম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকতা বিরোধী ভাবনা ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার ফসল। এই সময়ে গণনাট্য সংঘে সলিল তৈরি ক’রে চলেছিলেন একের পর এক বিপ্লবের গান, প্রতিবাদের গান, এদেশের শোষিত ও সংগ্রামী শ্রমজীবী মানুষের জন্যে আশার গান, মুক্তির গান। কোনও সন্দেহ নেই যে শিল্পী হিসেবে সলিল ছিলেন সমস্ত সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের একনিষ্ঠ এবং কড়া সমালোচক। এ কথা বোধহয় সকলেই মানবেন, যে এই সময়কালে সলিলের বেশ কিছু রচনা সংগীতের গুণগত মানের নিরিখে আধুনিক ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে সেরা কাজগুলির মধ্যে জায়গা করে নিতে পারে। ও আলোর পথযাত্রী তেমনই একটি কম্পোজিশন।

যা জানছি, তাতে গণনাট্য সংঘের তরফে দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র সহ অন্যান্য শিল্পীর কন্ঠে এই গান প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৪৯ সালে। পরবর্তীকালে অন্যান্য অনেকে নানাবিধ প্রয়োজনে গানটি রেকর্ড করলেও সলিলের নিজের তত্বাবধানে এ গান যখন আবার রেকর্ড হয় ১৯৭১ – এ; মান্না দে, সবিতা চৌধুরি প্রমুখের কন্ঠে ও নতুন অ্যারেঞ্জমেণ্টে এক অন্য মাত্রা পেয়েছিল। এর পরে ‘ঘুম ভাঙার গান’ শীর্ষক এক অ্যালবামের জন্যে সলিল আরও একবার গানটি রেকর্ড করেন, যাতে গান শুরুর আগে তিনি স্বকণ্ঠে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হিসেবে বলেন: “স্বাধীনতার পর যে সাময়িক শ্লথতা নেমে এসেছিল আমাদের দেশের সংগ্রামী মানুষের মনে, তাকে পুনরুজ্জীবিত করার তাগিদে রচিত হয়েছিল এই গান – ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রি; এখানে থেমো না”।

আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, আর সামান্য গানবাজনা করার চেষ্টা করছিলাম, আরও অনেকের মত সলিল চৌধুরির আদিগন্ত কাজ গুলোর সামনে দাঁড়িয়ে একই সঙ্গে অবাক ও মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ছেলেবেলা থেকে সলিলের রেকর্ড করা আলোর পথযাত্রীর সব কটা সংস্করণ শোনার সৌভাগ্যই আমার হয়েছিল। নিজের মত করে নিজেই গান গুলোকে ভাবার চেষ্টা করতাম। গানটার দুটো অংশ। প্রথম অংশ আলোর পথযাত্রীর কাছে অন্ধকারে না থামার স্তব, যেটা মেজাজে অনেকটা আধ্যাত্মিক। সুরগুলো যেন গসপেলের মত স্থির, টানা টানা। গসপেলের সাথে হার্মনির কাঠামোতেও বেশ মিল। স্তবটা দ্বিতীয় অংশে এসে আর স্তব থাকে না, মাঠ ঘাট বন পেরিয়ে যখন আহ্বানটা শোনা যেতে শুরু করে। তখন সেটা শুধু এগিয়ে চলার কথা বলতে বলতে মার্চিং সং এর ধাঁচায় ঢুকে পড়ে। এখানে অ্যারেঞ্জমেন্টের ধরণ আলাদা। এ গান একলা গাইবার গান নয়। এটা সেভাবেই তৈরি, যাতে একটা choir এর শিল্পীরা সকলে মিলে গাইতে পারেন। যদিও এ গানের কিছু কিছু অংশ একক পুরুষ ও মহিলা কন্ঠের প্রয়োগ দাবী করে। আমি লক্ষ্য করেছিলাম, সলিল যতবার গানটি রেকর্ড করেছেন, ততবারই বদল ঘটিয়েছেন মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টএ। ততবার ই আলাদা আলাদা ধরনের হার্মনি রচনা করেছেন। তাঁর মত দক্ষ সংগীতায়োজক সম্ভবত রেকর্ডিং এ অংশ নেওয়া কন্ঠশিল্পীদের সাংগীতিক সামর্থ মাথায় রেখেই এটা ক’রে থাকবেন। আবার এও তো সত্যি, যে তিনি সলিল চৌধুরি; যে মানুষ পুনরাবৃত হন না… হতে চান না…

আলোর পথযাত্রী আমার উইশ লিস্টে ছিল অনেক দিন ধরেই; যদিও আমি কোনদিন বাজিয়েও দেখিনি গানটা। না, কোনও অসতর্ক মুহূর্তেও না। ভাল একখানা মিউজিক ট্র্যাকের খোঁজ ক’রে গেছি শুধু, যার ওপরে গানটা আমি আদৌ বাজাতে পারব। এমনকি আমার মিউজিশিয়ান বন্ধুরা, যাঁরা ডিজিটাল যন্ত্রপাতি নিয়ে সাংগীতায়োজনের কাজ ক’রে থাকেন, তাঁদেরও বলেছি, আমার জন্যে এ গানটার একটা ট্র্যাক বানিয়ে দিতে; কিন্তু যে কারণেই হোক, সেটা আর হয়ে ওঠেনি।

এ গানটা নিয়ে আরেকটা মুশকিল ছিল এর choral ফর্ম। হার্মনিগুলো বাদ দিয়ে এমনি এমনি বাজালে কম্পোজিশনটার কোনও মানেই থাকে না। এই মুশকিলটা যদিও আসান হয়ে গিয়েছিল আমার আগের রেকর্ডিং – ‘মরি হায় গো হায়’ এর সময়ই। সেবারে ভেবেছিলাম – যদি দুটো ভায়োলিন, একটা ভিয়োলা আর একটা চেলো দিয়ে আস্ত একটা স্ট্রিং কোয়ার্টেট তৈরি হতে পারে, চারটে হারমোনিকা কী দোষ করল? আর এবারে ভাবলাম, চারটে মানবকণ্ঠ যদি কোরাস গাইতে পারে, চারটে হারমোনিকা কেন নয়…

‘মরি হায় গো হায়’ এর বেলায় একটা গিটার দিয়েই রিদম এর ব্যাপারটা ম্যানেজ করেছিলাম। কম্পোজিশনটার সুরেলা ধরণ সেটা করতে বাধাও দেয়নি। কিন্তু এ গানটা আলাদা। এখানে রিদম-এর একটা বিশেষ ভূমিকা আছে, আর তাই আসল পারকাশন যন্ত্র ছাড়া চলবে না। দৌড়লাম রোল্যাণ্ড এর বাজনার দোকানে। একটা বংগ আর কী একটা নাম না জানা আফ্রিকান যন্ত্র কিনলাম। কিন্তু মাথার ভেতরে যেটা বেজে চলেছিল, তার শব্দের সাথে এ শব্দ সম্পূর্ণ মিলছিল না। তাই ফের ঢুঁ মারতে হল লালবাজারের গলিতে। এটা সেটা বাজিয়ে দেখে দু-রকম শব্দ করা দু-খানা ড্রাম আর একটা কাবাকাস কিনে বাড়ি ফিরলাম।

অ্যারেঞ্জ করার সময় যথারীতি সলিলের ধার কাছ দিয়েও গেলাম না। কারণ, ইংরিজিতে যাকে বলে, সেটা আমার চায়ের পেয়ালা নয়। মেলোডি আর মেজাজটাকে এক রেখে দিয়ে নিজের অক্ষমতার মাপে কর্ড আর হার্মনি গুলো বানালাম নতুন ক’রে।

চারটে ট্র্যাক এ বাজালাম গিটার (বেস গিটার সমেত)। একটায় ড্রামস, একটায় বংগ, একটায় কাবাকাস। আরও চারটে ট্র্যাক রাখলাম হারমোনিকার জন্যে। এই হল আমার যন্ত্রপাতি। সাধারণ গিটারকে বেস গিটারে পাল্টে দেওয়া স্যাম্পলড টোনটুকু বাদ দিলে সব ধ্বনিই এক্যুস্টিক।

একটা ঠিকঠাক ড্রামসেট ছাড়াই কাজ চালাতে হয়েছে ব’লে ড্রামস গুলোকে আমি একটু আলাদা ভাবে, একটা খালি হাত আর অন্য হাতে স্টিক ব্যবহার ক’রে বাজিয়েছি। হাতের চাপের তারতম্যে তারতম্য ঘটিয়েছি শব্দের। বংগ’র বেলায় কোনওক্রমে শব্দ বের করতে পারলেও এটাই আদতে বাজানোর পদ্ধতি কিনা তা এখনও জানি না। শুধু এক বন্ধুকে ফোনে ক’রে জেনে নিয়েছিলাম বংগ কোন কোন পর্দায় বাঁধা হয়। ব্যাস! সেই ছেলেবেলায় কয়েক বছর তবলা শিখতে হয়েছিল, তারপরে আর জীবনে কোনও পারকাশন যন্ত্র বাজইনি। ফের ঘাম ঝরাতে হল অ্যাদ্দিন পরে।

আমার অশিক্ষিত ও অনভ্যস্ত হাতে বাজানো গিটারের কথা আর না বলাই ভাল। মার্জনা চাইছি।

সম্ভবতঃ জানুয়ারী মাসে শুরু করেছিলাম কাজটা। শরীর গতিক সামলে, আপিস সামলে চুরি-চামারি করে যেটুকু সময় নিজের জন্যে পেয়েছি, সেই গতিতে কাজ হয়েছে। আপনারা হয়তো হাসবেন, বলবেন ছেলেমানুষী… কিন্তু এমন অকারণ অনাবিল আনন্দ যদি সঙ্গীত না দেয় আর কে দেবে? এরকম কয়েকটা আনন্দের জন্যেই শুধু বেঁচে থাকা যায়…

৯ মার্চ, শুক্রবার, ২০১২
দমদম ক্যান্টনমেন্ট

Comments
4 Responses to “ও আলোর পথযাত্রী [O Alor Pathojatri]”
  1. Mitthu Chaudhuri says:

    এই পোস্টটা দেখেছিলাম আগেই। কিন্তু পরে শুনব বলে অপেক্ষা করছিলাম, কেননা আপনার বাজনা যেমন-তেমন করে শুনতে পারি না। চারপাশ থেকে কাজ-অকাজের ফাঁস এমন চেপে ধরেছে, যে অবসরই হচ্ছিল না। আজ শুনতে বসলাম।
    আপনার বাজনা সম্পর্কে প্রথমেই যেটা আমার মনে হয়, তা হল দৃশ্যতঃ শোনা। আর সঙ্গের গল্পটুকু ভারী উপভোগ করি।
    এবারেও তাই তারিয়ে তারিয়ে গল্প পড়ে তারপর শুনলাম সুর। ‘ভাল লাগল’ শব্দটা ঠিক বোঝায় না কিছু। তাই অনুভব প্রকাশের ক্ষেত্রে সবসময় সেটা ব্যবহার করতে মন চায় না। এখন আরও বেশ কয়েকবার শুনব এই সুর।
    হারমোনিকার বাইরে যে বাজনা, সেটা যেন এক নদী, একটানা জলের শব্দের মত সঙ্গত রেখেছে। দীর্ঘ যাত্রার মত সুরের প্রসারকে ধরেছে একটানা শান্ত প্রক্ষেপে।
    আবারও এক নতুন সুরের অপেক্ষায় রইলাম। শুভেচ্ছা জানাই। কীর্তি কামনা করি।

    • Sumanta Basu says:

      বড় ভাল বলেছেন। “দীর্ঘ যাত্রার মত সুরের প্রসার কে ধরেছে একটানা শান্ত প্রক্ষেপে”।
      যন্ত্রানুষঙ্গের এমন উপমা বিরল, সহজলভ্য নয়। এ কেবল আপনিই বলতে পারেন।

  2. Supperb—No more accurate words to describe the feelings–

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

  • Blog Stats

    • 19,879 hits
  • Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

    Join 22 other subscribers
%d bloggers like this: