ঘর থেকে পথে [Reaching Out]
শরীরটা বেশ খারাপই লাগছিল সকাল থেকে। মাথাটা কেমন যেন ব্যথা ব্যথা করছিল। সাত তাড়াতাড়ি দমদম এয়ারপোর্টে এসে বসেছিলাম। হাতে অঢেল সময়; সিকিউরিটি চেক চুকিয়ে বোর্ডিং পাস পকেটে ঝিম মেরে বসে থাকা ছাড়া অন্য কাজ ছিল না।
লাউঞ্জে সার দিয়ে চেয়ার পাতা; আর তাতে সারি বেঁধে বসে আমারই মত আগেভাগে চলে আসা মানুষজন। এইসব ঘড়ির সাথে পাল্লা দেওয়া লোকেরা যাতে বোর না হন; বেশ কয়েকটা টিভি ঝুলছে কিছুদূর অন্তর; আর তার একেকটাতে একেকরকম অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। কোনটাতে খবর। কোনটাতে খেলা। কোনটাতে বোম্বাইয়া নাচা গানা। ওগুলোর কোনও একটার সামনে বসে অকারণ ‘দেখছি দেখছি’ ভাব করে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু দেখবনা আসলে কোনটাই। কেউই কি দেখবে?
সকালবেলাটা খবরের সময়। নিউজপ্রিন্টের ওপরে টাটকা কালির চেনা গন্ধটা সকালবেলায় বড্ড টানে। কিন্তু তাই বলে টিভির খবর? হাতের খবর-কাগজটার প্রায় প্রত্যেকটা লাইন মুখস্থ হয়ে এল। কয়েকটা ঝুলন্ত টিভির মধ্যে অকারণ তাকিয়ে থাকার জন্যে কোনটাকে বাছা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবে খবর যে দেখব না সেটা মনে মনে ঠিক করাই ছিল। বোম্বাইয়া নাচ তো আরও সাংঘাতিক। ওর’ম আকাট জিনিস দুনিয়ায় খুব কম আছে। কেউ যদি কখনও সাউন্ডটা মিউট করে দিয়ে একলা ঘরে টিভির দিকে তাকিয়ে সে সব দেখেন আর ভাবার চেষ্টা করেন যে মাথায় নরমাল বুদ্ধিশুদ্ধিওলা কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কী করে ওরকম চিড়িয়াঘর সুলভ অঙ্গভঙ্গি করতে পারেন – তো বিপদে পড়ে যাবেন; ভাবনার দিব্যি। ও জিনিস দেখা যায় না। এমনকি টাইম পাসের জন্যেও না; যেটাকে আমেরিকানরা বলে থাকেন ‘টাইম কিল’ করা – সেই উদ্দেশ্যেই আমার সমস্ত কিলার ইনস্টিংক্ট একত্রিত করে ক্রিকেট দেখানো ঝুলন্ত টিভির দিকে এগিয়ে গেলাম। ব্রায়ান লারার ভরসায়।
নেপথ্যে পোর্ট ব্লেয়ারের বোর্ডিং অ্যানাউন্সমেন্ট কানে আসছে। যেটা শুনে চোখ বুজলেই সবুজ কোরালে ঘেরা সাদা বালির তট ঝিলিক মেরে যাচ্ছে। ছবিতেই দেখেছি শুধু। কোনও দিন হয়ত যাব… যাক গে – আপাতত ক্যারিবিয়ান আইল্যাণ্ডেই মন ফেরাই। আবারও ব্রায়ান লারার ভরসায়।
আমার ঠিক পেছনের রো-তে বসা এক গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীর হয়েছে আরও জ্বালা। ‘সন্ন্যাসী’ শব্দটার বদলে ‘মহারাজ’ বললে হয়ত তাঁর গেরুয়া টুপি – গেরুয়া মোজা সমেত ক্লিন শেভন্ চেহারাটা আন্দাজ করে নেওয়া যাবে এক ধাক্কায়। তিনি হয়ত ভাবছিলেন এয়ারপোর্ট অথরিটি কেন যে একটা অন্তত ভক্তিমূলক ঝুলন্ত টিভি রাখেননি! ব্রায়ান লারার ওপরে তাঁর আবার বিশেষ একটা ভরসা-টরসা আছে বলে তো মনে হল না। ‘মহারাজ’ হলেও ইনি মনে হয় ক্রিকেটে তেমন একটা আগ্রহী নন।
কয়েকটা পরিবার আবার আর কিছু করার না পেয়ে গোগ্রাসে গিলছেন। এয়ারপোর্টে যা মিলছে তাই। এই সাত সকালে কেউ এত খেতে পারে? কেউ কেউ বিরামহীনভাবে নিজের মোবাইল ফোনটার সাথে খুটুর খুটুর করে চলেছেন। হাতব্যাগ থেকে বেরিয়ে এসে কারুর কারুর আবার কোলে চ’ড়ে বসেছে ল্যাপটপ।
সময়টা পুজোর, কাজেই বেশিরভাগই দেখছি চারিদিকে ‘আমিও হব পর্যটক’ মার্কা মুখ করে বসে আছেন। সক্কলেই প্রায় বেড়াতে যাচ্ছেন। সারা বছর আর ছুটি কোথায়?
বিমান যাত্রা আমার বিশেষ ভাল্লাগে না। কাঠের পুতুলটি হয়ে বসে থাকা ছাড়া দ্বিতীয় কাজ নেই। জানলা দিয়ে যে দেখবো; দেখার মত বিশেষ কিছু নেই। শুধু নীল। ফিকে গাঢ় হরেক রকম, বাট নো গাঙচিল। কাজেই ভেবে দেখলাম বাড়িতে অর্ধেক ফেলে আসা ঘুমটুকুর কিছুটা অন্তত কমপেন্সেট করে ফেলতে পারলে মন্দ হবে না। মা কে পাঠিয়ে দিলাম জানলার ধারে। আমি দ্বিতীয় সিটে বসে চোখ বুঁজলাম।
কলকাতা থেকে পটনা ছুঁয়ে আমাদের লখনৌ নামিয়ে দিয়ে এ প্লেন কোথায় যাবে ঠিক করে শুনিনি। যাবে কোথাও একটা। দিল্লি বা মুম্বই যাবে কি? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুমের মধ্যেই খুব অস্ফুটে একটা গুনগুন কানে আসছিল। আর সেই গুনগুনের সুরটা যেন চেনা চেনা লাগছিল। চেনা সুর হলে যা হয়; সুরের যে অংশটা আসব আসব করছে, সেটাকে ডেকে আনার জন্যে মনটা আকুলি বিকুলি করতে থাকে। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই সুরটার সাথে সেই খেলাটা খেলতে খেলতে ক্রমশ সেটা শব্দের আদল নিল। ‘বল মা তারা দাঁড়াই কোথা – আমার কেউ নেই শঙ্করী হেথা – মা’র সোহাগে বাপের আদর, এ দৃষ্টান্ত যথা তথা।’
নাহ্ – আর ঘুমোন সম্ভব না। ঘাড় কাত করে গুনগুনের উত্স সন্ধানে চোখ ফেরালাম। আমার ঠিক পেছনের রো থেকে এরোপ্লেনের গোঁ ছাপিয়ে আসছে শব্দটা। জানলা দিয়ে সকালের সোনালী আলো এসে পড়ছে এরোপ্লেনের দুধ-সাদা ইন্টিরিয়র ওয়ালে। সেই আলোতে দেখি বাবাজি – থুড়ি মহারাজ এখন গান গাইছেন। জানলার খুপরিটার ঠিক পাশে ঠেকানো রয়েছে গেরুয়া টুপি সমেত মাথাটা। ঠিক সোনার কেল্লার মুকুলের ভঙ্গীতে আপন মনে বারে বারে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওই রামপ্রসাদী সুর গেয়ে চলেছেন তিনি।
বাইরের দিকে তাকালাম। পুজোর সময় বলেই বোধহয় আকাশে নীলের একঘেয়েমিটা নেই। নানান শেপের হালকা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে কাছে – দূরে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাসছিলাম আর মহারাজের গান শুনছিলাম। হঠাত্ একটা সাদা টুকরোর দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত্ করে উঠল। এ তো ঠিক মেঘ নয় –
বেশ খানিকটা দূরে নিচের দিকে যেন পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ জড়ো হয়ে এমন একটা আকৃতি নিয়েছে, যেটা আমার বিশেষ চেনা! ঘুমের যেটুকু চোখে লেগেছিল, উধাও হয়ে গেল। ওর ছবি যে আমার শোবার ঘরে, বৈঠকখানা ঘরে সযত্নে বাঁধিয়ে রাখা আছে। ওটা মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা।
একবার মনে হল আমি কি ভুল দেখছি? অসম্ভব। আর কিছু ভুল হলেও এটা ভুল হবার কোনও চান্স নেই। খালি চোখে কিম্বা ভিউফাইন্ডার-এ চোখ রেখে ওর ওই জাইগ্যান্টিক সপারিষদ উপস্থিতি আমি অনেকবার অনেক জায়গা থেকে দেখেছি। কিন্তু এইখান থেকে যে এইভাবে ওকে দেখতে পাব, একবারও ভাবিনি। এরোপ্লেনটাও যেন ওই দিকেই এগোচ্ছে। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকলাম ওদিকে।
কাঞ্চনজঙ্ঘাটা একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছে চোখের সামনে। একটা সিট টপকে জানলার বাইরে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড়ে ব্যথা করছিল, কিন্তু সেটা বোঝার মত অবস্থায় বোধহয় ছিলাম না।
শুনেছি আঠেরো শতকের মাঝামাঝি অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় ফ্রান্জ অ্যান্টন মেসমার বলে এক ডাক্তার থাকতেন, যিনি সম্মোহনের সাহায্যে রোগ-চিকিত্সার এক অদ্ভূতুড়ে থিওরিতে বিশ্বাস করতেন। তাঁর নাম থেকেই ‘মেসমেরিজম’ কথাটা ইংরিজি অভিধানে ঢুকে পড়েছিল। আর এই একুশ শতকের ভারতবর্ষে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় পঁয়তিরিশ হাজার ফুট ওপরে ভাসতে ভাসতে টের পেলাম ‘মেসমারাইজিং’ কাকে বলে।
একে একে আশেপাশের শৃঙ্গগুলো চোখে স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়তে শুরু করেছে। দেখলাম বুদ্ধ শুয়ে রয়েছেন পরম নিশ্চিন্তে। সান্দাকফু থেকে তাঁকে দেখেছি সোজাসুজি। প্রায় আই লেভেল ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লং শট-এ। আর এবারে দেখছি টপ শট। এরোপ্লেন এগোচ্ছে বলে যা একই সঙ্গে ধীরে ধীরে জুম ইন করছে আর ছবি ফ্রেমের ডানদিকে প্যান করে যাচ্ছে।
কাঞ্চনজঙ্ঘার ডান দিকে ‘পাণ্ডিম’কে স্পষ্ট চিনতে পারলাম। তার বাঁদিকে ‘সিমভো’কে আন্দাজ করে নিতে হল, কারণ সেটা তুলনায় অনেক ছোট। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার ঠিক বাঁদিকে নর্থ আর সাউথ দুই ‘কাব্রু’কেই চেনা গেল। আর চেনা গেল অনেকটা হাওড়াব্রিজের মত মাথাওলা ‘কুম্ভকর্ণ’কে। যেটা আবার স্লিপিং বুদ্ধর মাথা।
দু চোখ ভ’রে শুধু দেখছি। আশেপাশে ছড়ানো ছেটানো অসংখ্য বরফে ঢাকা শৃঙ্গ। যাদের কোনটাকেই চিনি না। নাম জানি না। বাঁ দিক বরাবর দৃষ্টির লাইন টানতে টানতে মনে মনে যেটাকে খুঁজছিলাম, সেটাকে দেখলাম অনেকখানি তফাতে। ডানকাঁধ উঁচু পিরামিডের মত দেখতে সেই চুড়োটার নাম মাউন্ট এভারেস্ট। যেটাকে না চিনতে পারলে তার গায়ে প্রায় ল্যাপ্টালেপ্টি করে থাকা ‘লোত্ সে’ আর ‘ন্যুপত্ সে’ – কে চেনা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। আর সে চেনাই যদি ঠিক চেনা হয়, তো আরও কিছুটা পেছনে, সামান্য ডানদিকে যেটা আকাশের দিকে নিজের ছুঁচলো ফলা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেটা ‘মাকালু’ না হয়ে যায় না।
মহারাজের গান কখন থেমে গেছে খেয়াল করিনি। ঘাড়ের ব্যথাটা টের পেলাম যখন, ততক্ষণে চেনা সব পিকগুলো দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে মনে মনে ভারতবর্ষের একটা মানচিত্র এঁকে নিলাম। আর মনে মনেই তাতে কলকাতা, পটনা আর লখনৌকে পয়েন্ট করে মাউন্ট এভারেস্টের দেশ নেপালের অবস্থানের নিরিখে ভাবার চেষ্টা করলাম এই প্লেনটা কোন রাস্তা ধরে চলছে। এসব সাত-সাতেরো ভাবতে ভাবতে ঘোষণা শুনলাম প্লেন পটনায় নামবে, যাত্রীরা যেন কোমর বেঁধে তৈরি থাকেন।
বাইরের নীলে ততক্ষণে ফ্যাকাশে পল্যুশনের ছোঁয়া লেগেছে। নিচে চাষের ক্ষেত, গাছপালা সব আবছা আবছা দেখা যেতে শুরু করেছে। আর যেটা বিশেষ ভাবে দেখা যাচ্ছে, সেটা চওড়া বহরের গঙ্গা নদী। দেখতে দেখতে গঙ্গা স্পষ্ট হল। মাঠ, ঘাট, বন, বাদাড়, শহর, কংক্রিট, রাস্তা, ফ্ল্যাটবাড়ি, শপিং মল, ট্রাফিক, যান-জট, পুলিশ, বাস, অটোরিক্সা, সাইকেল – সমস্ত যথা নিয়মে স্পষ্ট হয়ে উঠল। এই এত সব কিছুর ভিড়ের মধ্যে কী করে যেন ঠিক রানওয়ে টিপ করে প্লেনটা নিজেকে নামিয়ে ফেলল। তারপর ছুটতে ছুটতে যেখানে থামল, সেটা জয়প্রকাশ নারায়ণ ‘হাওয়াই আড্ডা’।
একটুক্ষণ পরে আড্ডা ছেড়ে আবার হওয়ায় ভাসল বিমান। মনে মনে আঁকা ভারতের ম্যাপ অনুযায়ী আর পাহাড়ের ভিউ দেখার সম্ভাবনা নেই। শুনলাম এ জাহাজের কাপ্তেন বদল হয়েছে। এনার ইংরিজি উচ্চারণ আগের কাপ্তেনের থেকেও খারাপ। ফ্লাইট অ্যাটেণ্ডেণ্ট দ্বিতীয় দফার মূকাভিনয় সেরে চলে গেছেন। মহারাজ আবার গান ধরেছেন; তবে এবারে শুধুই গুনগুন, আর সুরটাও অচেনা। আমার ওপাশের একটা তাগড়া গোঁফওলা লোক সুইচ টিপে একজন ফ্লাইট অ্যাটেণ্ডেণ্টকে ডেকে চিল্ড বিয়ার চাইলেন। সে বেচারী অ্যালকোহল নিষেধ জানিয়ে বিয়ারের বিকল্প হিসেবে ফলের রসের প্রস্তাব পাড়লেন এবং তাগড়া গোঁফ বিরক্তিসূচক বিড়বিড় সহযোগে প্রত্যাখ্যান করলেন। আর আমার চোখটা বুঁজে এল।
(ক্রমশঃ)
১৩ মার্চ, বুধবার, ২০১৩
দমদম ক্যান্টনমেন্ট
bhalo laglo pore. bakita porte icche korche……….
বাকিটা নয়, বাকিগুলো। যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে বেশ কয়েকটা ইন্সটলমেণ্টে না ভাঙলে চলবে না।
চলুক। ভালো লাগছে।
ami nemokharam noi sankori… bahabbai jay na sadhu banglar somoye emon asadho antorik sobdo byabohar. tomake bachano muskil. prothome bhebechilam Rabindranath ekhon dehchi Ramprosado tomake khachhe. tomake bachay kar baper sadhhi! Dub dere mon kali bole!
মিহিরবাবু, সুরের দুনিয়ায় আমার মাথা খাবার মত লোকের অভাব নেই। কারা কারা যে আজ অবধি সাক্সেসফুলি খেযে উঠতে পেরেছেন, তা তাঁরা নিজেরাও জানেন না; আর আমিও সে সব হিসেব রাখা ছেড়ে দিয়েছি। 🙂
চলছে না। কিন্তু চলবে।
besh hochchhe. prothagato bhramon kahinir mato hochchhe na, eta besh valo lagchhe. chaliye ja…
আলবাত চালাবো। এপ্রিল মাসটা আগে মার্চের ধাক্কাটা সামলে উঠুক…
সুন্দর ঝরঝরে লেখা । ভাল লাগছে পড়তে ।
বলছো?
এপ্রিল মাস কি এখনও মার্চের ধাক্কা সামলাতে পারেনি?
নাঃ মনে হচ্ছে লং মার্চই বটে৷