তৃতীয় সূত্র [Third law]
ছেলেবেলায় যখন ইস্কুলে নিউটনের তৃতীয় সূত্র হিসেবে পড়তাম, যে সব ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে; ব্যাপারটাকে একটু – যাকে বলে ‘বুকিশ’ ব’লে মনে হতো। ধেড়ে বয়েসের খামখেয়ালের মধ্যেও যে ত্রিলোকেশ্বর বাবুর বেড়াল বর্তমান, সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। নইলে সেবার জুলাই মাসের বর্ষায় হঠাত্ বসন্তকে টেনে এনেছিলাম ব’লে এই মার্চের গনগনে বসন্তে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত বর্ষা এসে হাজির হয়!
তারও বেশ কিছুদিন আগে – সেই যে সেই একটা নতুন গৃহপালিত স্টুডিও মাইক্রোফোন কিনে এনে ‘তুমি কেমন ক’রে গান করো হে গুণী’ রেকর্ড ক’রে ‘হ্যালো হ্যালো মাইক টেস্টিং’ করেছিলাম; ভেবে দেখলাম সেইদিন থেকেই নিজেকে নিজে সঙ্গত করার একটা ভাবনা মাথার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, আর থেকে থেকেই নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার (আসলে শেখার চেষ্টার) ভেতর দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল সেটা।
আমি আর আমার বন্ধু অভ্র – মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের কাজ যে আগে করিনি তা নয়, কিন্তু সে সবই কখনও অভ্র আবার কখনও অন্য কেউ গাইবেন বলে। নিজের জন্যে কক্ষনো না। আর তাছাড়া সে ধরণের কাজগুলোর ক্ষেত্রে রেকর্ডিং হতো স্টুডিয়োতে। ইন্ডাস্ট্রির পেশাদার যন্ত্রশিল্পীরা যে যার নিজের নিজের পার্ট বাজাতেন। কোথায় কোন যন্ত্রে কোন সুর কোন তালে কোন ছন্দে বাজবে সেটা আগে থাকতে ভেবে নিয়ে সব কটার জন্যে আলাদা আলাদা স্বরলিপি লিখে প্রত্যেকের হাতে হাতে ধরিয়ে দিয়ে, যার যার পার্ট বুঝিয়ে হাত পা নেড়ে কন্ডাক্ট করা, রেকর্ডিস্টের ঘর থেকে মাইক্রোফোনে বেসুরো গলায় সরগম গেয়ে গেয়ে ইন্সট্রাকশন এর ফুলঝুরি ছোটানো, বাজনা ঠিক হলে ‘ওকে’, আর ভাল না হলে ‘এনজি’ বলা – মোটের ওপরে এই ছিল দায় দায়িত্ব। গানবাজনার লোকেরা বুঝবেন যে পদ্ধতিগত ভাবে আমি নেহাতই পুরোনো পন্থী। কেননা কোনও এক্যুস্টিক (অথবা গিটার, বেস গিটার, কীবোর্ডস, অক্টোপ্যাডের মত ইলেক্ট্রনিক) যন্ত্র আর যন্ত্রশিল্পী ছাড়াই, ডিজিটালি স্বর ও সুর তৈরি করে অর্থাত্ ডিজিটালি সাউন্ড ‘সিকোয়েন্স’ করে অ্যারেঞ্জ করা তো দূরে থাক, তেমন কোনও যন্ত্রও কস্মিন কালে আমার ছিল না। ফলে সে ব্যপারে কোনও রকম জ্ঞানগম্যিও নেই।
আমি যে যন্ত্র বাজাই সেটা একটা এক্যুস্টিক যন্ত্র। পিয়ানো বা হারমোনিয়াম প্রথাগত ভাবে শেখার সুযোগ আমার হয়নি শুধু না, এই সেদিন অবধি বাড়িতে কোনও কীবোর্ড গোত্রের যন্ত্রই ছিল না (এমনকি একটা হারমোনিয়ামও ছিল না, যেমনটা আমার ছোটবেলায় আর পাঁচটা বাঙালি বাড়িতে থাকত)। যাও বা কিনলাম কদিন আগে; সেটা একটা মেলোডিকা। অর্থাত্ সেটাও এক্যুস্টিক। আমি ইলেক্ট্রনিক গান বাজনা শিখিনি।
এখন হয়েছে কী, স্টুডিওতে নিজের বাজনা রেকর্ড করব, অত পয়সা তো নেই। অ্যালবাম রিলিজ করবো – ধুর কিনবে কে? মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগারের টাকা জলে যাবে।
এদিকে যা সমস্ত গানবাজনা শুনছি বাজারে এবং আশেপাশে, সেসব শুনে তো বড় হইনি; গানবাজনার জায়গা থেকে বড্ড একলা আর বেখাপ্পা লাগে। আমার মননকে ‘চার্ম’ করতে পারে এমন সংগীত বড় একটা পাচ্ছি না। বড্ড ব্যক্তিগত অনুভবের জায়গা এটা। কিন্তু যেটুকু শুনে, শিখে বড় হয়েছি; যে সুর মনের মধ্যে বাজতে চায়, সেটা প্রকাশ না করতে পারলে পারফর্মিং আর্টিস্টের যে আর কোনও চুলোয় যাবার জায়গা থাকে না; এইরকম একটা একাকীত্ব আর অসহায়তার জায়গা থেকেই হয়ত আমার বাড়িতে রেকর্ডিং করা এবং ইন্টারনেট মাধ্যমটা ব্যবহার করার কথা মাথায় আসে। আর পাঁচজন পারফর্মিং আর্টিস্টের মত আমারও তো শ্রোতা চাই। প্রতিক্রিয়া (সমান এবং বিপরীত!) চাই। নইলে তাগিদটা পাব কোথায়?
ইন্টারনেটের কথা মাথায় এসেছিল, তার কারণ – এক, পেশাগত ভাবে সেই সাতানব্বই থেকে আমি এই মিডিয়ার সাথে যুক্ত। মিডিয়াটাকে জানি। আর দুই, আমি যে পরিসরে নিজের কাজকে রাখতে চাইছি, তার জন্যে খরচ প্রায় শূন্য। যখনকার কথা বলছি, সে আমলে মানুষ এতটা ইন্টারনেট বিলাসী ছিলেন না। কাজেই ঝাঁকে ঝাঁকে অ্যামেচার কণ্ঠ (এবং যন্ত্র) তখনও ইন্টারনেটে ‘আমায় দ্যাখো – আমায় দ্যাখো’ বলতে শুরু করেননি। সেটা হয়েছে অনেক পরে। তা যাক গে। গণতন্ত্র ভালই জিনিস।
আমি করতাম কী, গানের ট্র্যাক যোগাড় করতাম। আর নেহাত সস্তা যন্ত্রপতি নিয়ে বাড়িতে বসে রেকর্ড করতাম। আজকাল প্রায় সব মিউজিশিয়ানেরই যেরকম ‘হোম স্টুডিও’ থাকে, ব্যাপারটা সেরকম নয়। আমার বন্দোবস্ত ছিল অনেক ঘরোয়া। আউটপুট কোয়ালিটি শুনে আজও অনেকেই বিশ্বাস করেন না যে, যে মাইক্রোফোনে ‘রাতের পাখি’, ‘কালার্স অব ক্লাউডস’ আর ‘দোজ ওয়ার দি ডেজ’ অ্যালবামের সমস্ত গান রেকর্ড করা, আদতে সেটা চাইনিজ মেক। দাম আড়াই’শ টাকা। আর সাউন্ড কার্ড? সবার যেমন থাকে – মাদার বোর্ড এর সাথে লাগানো।
যেটার ওপরে ভরসা করে লড়ে যেতাম, সেটা ছিল আজন্ম ভালবেসে গান শোনা দুটো কান।
এমনকি ঘোর গ্রীষ্মেও দরজা জানলা বন্ধ করে, পাখা বন্ধ করে, দরদর করে ঘামতে ঘামতে একটার পরে একটা টেক দিয়ে যাচ্ছি – রেকর্ডিংও করছি নিজেই – ওই ভাবে ভাল পারফর্ম করা কী যে কষ্ট সে যিনি করতে চেষ্টা করেছেন তিনিই কেবল বুঝবেন।
এখানে একটা কথা বলে রাখা খুব দরকার, অন্যের জন্যে তৈরি কারাওকে ট্র্যাকের ওপরে বাজানো আমার কোনও গান বা অ্যালবাম কমার্শিয়ালি রিলিজ করিনি; করার কথা ভাবিও নি। অথচ, একবার এমনকি যশস্বী এক কণ্ঠশিল্পীও তাঁর জন্যে তৈরি রবীন্দ্রসংগীতের ট্র্যাকএ আমি বাজিয়েছি এটা ‘আবিষ্কার’ ক’রে জনসমক্ষে ‘তাঁর জন্যে তৈরি ট্র্যাক’ ব্যাপারটিকে আন্ডারলাইন ক’রে দিতে ছাড়েন নি। আমার বাজনাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা ক’রে কী ক’রে যে তিনি পরমহংসের মত ‘তাঁর ট্র্যাক’ (যেটা গানের অনুষঙ্গ নয়, তাঁর সম্পত্তি) জল থেকে দুধ আলাদা করে নিয়ে শুনলেন, আর জনসমক্ষে নিজের কোলে ঝোল টানলেন, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। যেন ‘গহন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া’ গানটা হারমোনিকার মত একটা যন্ত্রে ফেলে ছড়িয়ে বাজানো হয় (অনেকটা ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা’র মত)। মানবেতিহাসে কতজন যে ইতিপূর্বে বাজিয়েছেন, এবং বাজাতে বাজাতে একই সঙ্গে নিজে নিজে রেকর্ড করেছেন, তারপর নিজেই মিক্সিং করেছেন – তার ইয়ত্তা নেই। আমার থেকে নিশ্চয়ই অনেক অনেক ভাল বাজিয়েছেন তাঁরা। আমার কাজটাতে উল্লেখযোগ্য হল কেবল গানের ‘ট্র্যাক’টি। যেটি তাঁর জন্যে তৈরি হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাঁর কোম্পানীই সেই ট্র্যাকটি আমার মত ‘ডোমেস্টিক অ্যানিম্যাল’দের কারাওকে সিডি আকারে বেচে দিয়েছেন। আর তাই দেখা গেল, রাজার ঘরে যে ধন আছে টুনির ঘরেও সে ধন আছে!
এ হল আরেক গল্প। কিন্তু গল্পের শেষ নেই। আরও বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমার কানে আসছিল, আরেকদল মানুষ কোথায় কোথায় যেন ব’লে বেড়াচ্ছেন ‘সুমন্ত বসু ব’লে লোকটা আসলে ততটা ভাল বাজাতে পারেন না, উনি মাল্টিমিডিয়া প্রফেশনাল, সাউন্ড প্রসেস ক’রে (অথবা কী ক’রে তাঁরাই জানেন) বাজনার উত্কর্ষ বাড়িয়ে দেন’। কী সাংঘাতিক। টেকনোলজি তো আজকের দিনে দারুন সহজলভ্য। তাহলে সকলেই আমার মত সে কাজ করে নেন না কেন? ‘করেন না কারণ তাঁরা মাল্টিমিডিয়া প্রফেশনাল নন’। দুইয়ে দুইয়ে চার।
অথচ কোথায় মাল্টি আর কোথায় মিডিয়া! আমি ওয়েব মাধ্যমে কাজ করা সামান্য একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। সংগীতকে ফটোশপে ফেলা গেলে না হয় আমার পেশাদারী কারিকুরি চলত। কিন্তু এ তো দেখছি না হচ্ছে কুচ না হচ্ছে কাওয়াজ। এঁরা না বোঝেন হারমোনিকা, না বোঝেন মাল্টিমিডিয়া। সংগীতের রসগ্রহণেই আসলে এঁরা অপারগ।
আর যাঁরা বোঝেন, চর্চা করেন? তাঁদের অনেকের ভেতরেই আবার দেখছিলাম অন্য একটা প্রতিক্রিয়া। ‘সুমন্ত বসুর বাজনার থেকেও রেকর্ডিংটা আরও চমত্কার’। ওই ‘ইটটা কম পাটকেলটা বেশি’র মত। ‘বাজনাটা কম শুনলেও চলে’ অথবা ‘ওরকমটা তো হয়েই থাকে; কিন্তু রেকর্ডিং… দ্যাট মেকস হিম ডিফারেন্ট’।
মনে হ’ত ধুত্তোর। এর চাইতে অ্যামেচার কোয়ালিটি প্রডিউস করে গুচ্ছের নয়েজওলা সাউন্ড ফাইল আপলোড করলে কি ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হত? সঙ্গীত যার পেশা নয়, তার কাজে ফিনেস থাকবে কেন? নিশ্চই ডাল মে কুছ কালা হ্যায়! তার ওপরে আবার আমার ফটোগ্রাফি আর ভিডিও এডিটিংএ আগ্রহ। তাহলে আমার সংগীত, ভাবনা, শ্রম, ভালোবাসা – এ সব হয়ে দাঁড়াল সেকেণ্ডারী।
ভেবে দেখলাম যেজন প্রেমের ভাব জানে না তার সাথে লেনাদেনা করা যায় না। সত্যজিত্ রায়ের দেশে জন্মে সামান্য কিছু সৃজনশীলতার পাঠ নেবার পরে কোয়ালিটির সাথে আপস করা যায় না। বরং নিউটনের তৃতীয় সূত্র মাফিক জেদ চেপে গেল এই ভেবে, যে আমার কাজে বাজনার আর শব্দের, দুয়েরই গুণগত উত্কর্ষ আরও বাড়িয়ে ছাড়ব।
এসব দেখে শুনে কারাওকে ট্র্যাকের ওপরে এমনিতেই আর বাজাতে ইচ্ছে করছিল না। কারণ সেটা করার মত অনেক লোক এসে গেছেন। আমাকে অন্য কিছু করতে হবে।
যন্ত্রপাতি কেনা শুরু করলাম। শরীর আর আগের মত অত্যাচার সহ্য করার মত অবস্থায় নেই। পারফর্ম করতে করতে রেকর্ডিং এর জন্যে কম্পিউটার ব্যাবহারে অনেক ঝক্কি। একটা ছোট্ট এইট ট্র্যাক ডিজিটাল রেকর্ডার কিনলাম। সঙ্গে সেই ‘রোড’ কোম্পানীর ‘এনটি১এ’ নামের একটা গৃহপালিত স্টুডিও মাইক্রোফোন। কেননা ভালো মাইক্রোফোন দরকার। যাঁরা ভাববেন ভালো মাইক্রোফোন থাকলেই ভালো কাজ করা যায়, সেটা তাঁদের সমস্যা। ভালো কণ্ডেন্সর মাইক্রোফোন শহরে বসে সাউন্ড আইসোলেটেড ঘর ছাড়া ব্যবহার করা যে কী যাতনার জিনিস কী বলব! ভালো মাইক্রোফোনের আর এক মাহাত্ম্য হচ্ছে সামান্য ত্রুটিকেই সে অনেক বড় করে দেখায়। কাজেই পারফরমেন্সে ফাঁকি দিলেই শ্রোতার কানে আরও বেশি বেশি ক’রে ধরা পড়বে।
আমার ওপরে ছিল প্রযুক্তি ব্যবহারের অভিযোগ(!!!)। এই আমি ‘পাতি যন্ত্র’ ত্যাগ করে যন্ত্রপাতি (এবারে একটু বেটার) সমেত প্রযুক্তিও পাল্টে নিলাম। চেষ্টা করতে লাগলাম হারমোনিকা নিয়ে অন্যরকম কাজ করার। আগে যা হয়নি, আমি না করলে অন্য কেউ সম্ভবতঃ কোনদিন করবেনও না – সেই রকম কাজ। সম্পূর্ণ একলা, মিনিমাম এক্যুস্টিক যন্ত্র ব্যবহার করে মিউজিক অ্যারেঞ্জ করার চেষ্টা করলাম। ‘ও আলোর পথযাত্রী’র শব্দকল্পদ্রুম তৈরি করলাম। গিটার আর হারমোনিকায় ‘মরি হায় গো হায়’ করলাম। হয়ত আমার কাজগুলোতে ‘রিলেটিভ মাইনরে’র ছড়াছড়ি নেই ব’লে অনেকে নাক সিঁটকেছেন, কিন্তু আমি তো সলিল চৌধুরী নই। যা তিনি পারেন আমি পারব কেন? আমি আমার মত ক’রে ভেবেছি। খারাপ হোক ভালো হোক, আমি না করলে তো ওভাবে কেউ ভাবতেনও না, করতেনও না।
‘প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে’ না বাজিয়ে ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুম নে জো দিল কো’ বাজালে আমার চ্যানেলে হিটস বাড়ত, টিআরপি বাড়ত। ‘চুরা লিয়া’ বাজানোর জন্যে আসলে অনেকে আছেন – আমি যাঁদের কোনও ভাবেই খাটো করছি না, অসম্মানও করছি না। তেমন মর্জি হলে আমিও হয়ত বাজাতাম কিম্বা কোনদিন বাজাবও হয়ত; কিন্তু যেটা হত, ‘প্রাণে খুশির তুফান’ যে হারমোনিকায় কেমন শুনতে লাগতে পারে সেটা অজানাই থেকে যেত। কেননা আর কেউ সেটা করার কথা ভাবতেন ব’লে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে না।
এইসব করতে করতে মাথায় নানারকম আইডিয়া এসে ভিড় জমাচ্ছিল। যার বেশীরভাগটাই হারিয়ে যাচ্ছিল। কত গান যে করব ভাবি – কিছুই করা হয়ে ওঠে না।
হয়ত নিউটনের তিন নম্বর সুতোর গেরোয় পড়েই, মাথায় আসছিল ডিজিটাল সিকোয়েন্সিং এর কথাও। কিন্তু ডিজিটালি সৃষ্ট সংগীতের একটি জিনিস আমার কক্ষণও ভালো লাগে না, সেটা হল তার গায়ের ডিজিটাল ডিজিটাল গন্ধ। ডিজিটাল অ্যারেঞ্জমেন্টগুলো যা শুনছি, বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। শব্দের কোনও আবেগ পাচ্ছি না। সংগীতে যেটা অস্বাভাবিক।
তাহলে কি ডিজিটালি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ অর্কেস্ট্রা রচনা সম্ভব নয়? ভার্চুয়াল হলেও যেটা শুনে মনে হবে কেউ আবেগ দিয়ে বাজাচ্ছেন? আর ওই ‘পিস’টা ওই ইন্সট্রুমেন্টে ওভাবেই বাজানো সম্ভব? মাথায় ঘুরছিল প্রশ্নগুলো। বুঝতে পারছিলাম উত্তর পেতে গেলে শিখতে হবে।
একটা একরত্তি এক্সটার্নাল সাউন্ড কার্ড, একজোড়া স্টুডিও মনিটর আর একটা মিডি কীবোর্ড কিনে ফেললাম। যার কোনও শব্দ নেই, শুধু একষট্টিটা সাদা কালো চাবি আছে। ইউএসবি দিয়ে কম্পিউটারে লাগিয়ে কোনও ‘ডিজিটাল অডিও ওয়ার্কস্টেশন’ সফ্টওয়্যারে ট্র্যাক তৈরি করে ভিএসটি অ্যাসাইন করলে তবে শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এ সব শেখানোর কেউ নেই, তাই নিজে নিজেই ঘেঁটে দেখতে লাগলাম। গুগল ভরসা। যা বুঝলাম সামনে সত্যিকারের সমস্যা না এলে শিখতে পারব না। কাজেই একটা কাজে হাত দিয়ে ফেলতে হবে। এটাই আমার শেখার রাস্তা। সারা জীবন আমি এভাবেই শিখে এসেছি।
‘ঝির ঝির ঝির ঝির ঝিরি বরষায় / হায় কী গো ভরসা আমার ভাঙা ঘরে তুমি বিনে’ – সলিল চৌধুরী তো মাথার ভেতরে দিনরাত্তির ঘুরঘুর করেন; যদিও সেদিন ঝরা শীতে বসন্তই ভরা ছিল, বৃষ্টির লেশমাত্রও ছিল না, কিন্তু সকাল থেকেই কানের পাশে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গাওয়া ‘পাশের বাড়ি’ ছবির এই গানটা হয়ে তিনি নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলেন। ঠিক করলাম এটাকেই প্রজেক্ট হিসেবে নিই।
রিদম প্রোগ্রামিং শুরু করলাম প্রথমে। ড্রামস, তবলা আর নানান পারকারশন যন্ত্রের শব্দ নিয়ে খেলতে খেলতে দাঁড়িয়ে গেল একটা কাঠামো। প্রথম প্রচেষ্টা ব’লে কোথাও কোথাও বেশ জটিল প্যাটার্ন হয়ে গেল। তবু আর না ঘেঁটে রেখে দিলাম সেটাই। কিন্তু বুঝলাম যে যত শিখবো, তত সহজ হতে হবে। আজকালকার সংগীতে সিম্পলিসিটির বড্ড অভাব। করা যাচ্ছে ব’লে এমন কিছু একটা বানিয়ে ফেললাম, যেটা অবিশ্বাস্য রকমের যান্ত্রিক, তা আমার ধাতে সইবে না।
এই করতে করতে একটা একটা করে যন্ত্র ফেলতে ফেলতে হয়ে উঠল গোটা গানের যন্ত্র-অনুষঙ্গ। এখানে বলে রাখা ভালো, সলিলের অ্যারেঞ্জমেন্টের মূল মেলোডিটা অক্ষুণ্ণ রেখে গানটাকে আমার মত করে অর্কেস্ট্রেট করেছি। অক্ষম অনুকরণ করার চেষ্টা করিনি।
এইভাবে আমার প্রথম প্রচেষ্টা একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল। শুনে দেখলাম খুব একটা ননমিউজিক্যাল কিছু শোনাচ্ছে না। কাজেই একটা ভিডিও শুট করে ফেললাম।
ভিডিওটা এডিট করার সময় হাসি পেয়ে গেল। ছবিতে যেমন দেখা যাচ্ছে ওইভাবে অনায়াসে কিন্তু আসলে আমি মোটেও কীবোর্ড বাজাইনি। ওভাবে আমার হাত-ই চলে না। শিখিনি যে। তবে সিনেমার অভিনেতারা যেমন পর্দায় পিয়ানো বাজিয়ে দেখান, সেই কাজটা তাঁদের থেকে অনেক ভালো করেছি বলতে হবে।
বুঝলাম এ কাজটা করতে হলে ভালো ক’রে পিয়ানো বাজানোটা শিখতে হবে।
আজ দোল। সলিলের বর্ষায় আমার খেয়ালের রঙ মিশিয়ে দিলাম। যদি একজনকেও সে রঙে ভেজাতে পারি কোথাও একটা শিরীষ গাছের পাতা হয়ত একটু হলেও ন’ড়ে উঠবে বেসামাল হাওয়ায়। সেই হবে আমার বসন্ত উত্সব।
২৭ মার্চ, বুধবার, ২০১৩
দমদম ক্যান্টনমেন্ট
Maharaja tomake selam! Mohashoy ami chakhik rupokar matro- Ramkinkor shantiniketoner ek adday sobdo koti bolechilen. Adho jonom ham o rup neharelu. bhalo besh bhalo lagar mon kemon kora ek bondhuke pelam chandananer kach theke.-
Mihir
মিহিরবাবু,
আপনার মন্তব্য প’ড়ে ভাল লাগলো। একই সঙ্গে রামকিঙ্করের প্রসঙ্গ তুলে লজ্জাতেও ফেলে দিলেন। ‘আমি চাক্ষিক, রূপকার মাত্র’ এই শিরোনামে তাঁর বিষয়ে সংকলিত চমত্কার একটা বই পড়েছিলাম। অমন মানুষ বিরল। আমার কাজের প্রেক্ষিতে তাঁর প্রসঙ্গ আসাটা আমার পক্ষে সত্যিই অস্বস্তিকর। কেননা আমি তার যোগ্য নই।
আশা করছি একদিন নিশ্চয়ই আমাদের মৌখিক আলাপ হবে। ভাল থাকবেন। – সুমন্ত