ফাল্গুনের তাপে [Phalguner Taape]

তিনি এসে দেখলেন আমি কাজ থেকে ফিরে আপিসের পোশাকটা গা থেকে সবেমাত্তর নামিয়ে চুপ ক’রে ব’সে ব’সে কী করা যায় তাই ভাবছি।

কয়েকদিন আগের কথা। ফেব্রুয়ারী তখন শেষের পথে। কী একটা দরকারে যেন আপিস থেকে বেরিয়েছিলাম একটু, হেঁটে ফিরছিলাম বেলভিউ নার্সিংহোমের উল্টোদিকের ফুটপাথ ধ’রে। আচমকা দেখলাম উজ্জ্বল লালরঙের কিছু ফুল ছড়িয়ে রয়েছে ফুটপাথের একটা বিশেষ জায়গায়। মাথা তুলে দেখি প্রকাণ্ড একখানা পলাশ গাছ, আর পলাশ ফুলে ছেয়ে রয়েছে তার ডালপালা। কী সুন্দর অথচ কী ভয়ংকর বেমানান! পাশ থেকে মিন্টো পার্কের সামনে দিয়ে এজেসি বোস রোডের দিকে ছুটে চলা ট্যাক্সি, মোটর সাইকেল, নানান কোম্পানীর নানান রঙের প্রাইভেট গাড়িগুলো, নার্সিং হোমের বিছানায় শুয়ে থাকা অসুস্থ মানুষদের উদ্বিগ্ন পরিজন, জাস্ট এমনি হেঁটে যাওয়া লোকেরা, সাদা জার্সি পরা ট্রাফিক পুলিশ, কৌটো হাতে যে দাড়িওলা ভদ্রলোক ভিক্ষে করছেন – কারুর দেখলাম কোনও রকমের ভ্রুক্ষেপও নেই। কিচ্ছু যায় আসেনা কারুর – অথচ শহরটাতে কী আশ্চর্য রকমের বসন্ত এসেছে। আমি খবর রাখিনি, তবু এসেছে। এখন কী করা যায়?

সিগারেট ছেড়েছি প্রায় তিন বছর হতে চলল, অথচ আমি নির্ঘাত জানি, আগে হ’লে ওই গাছটার তলায় ফুটপাথ থেকে ঝ’রে পড়া আগুন কুড়িয়ে নিয়ে তত্‍ক্ষণাত্‍ আমার সিগারেটে ছোঁয়ানোর কথা। সিগারেটটা সবটুকু জ্বলে শেষ হয়ে যাওয়া অবধি অন্ততঃ চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকার কথা সেখানে। সিগারেটের গন্ধ এখন আর ভাল লাগে না, কিন্তু অনেক দিন পরে ওই অ্যাক্টিভিটিটাকে মিস করলাম। বড় বেসামাল লাগলো নিজেকে – বুকের ভেতর হু হু ক’রে দেওয়া একটা নাছোড় ভাবনা মাথায় ঢুকে পড়ল পাকাপাকি ভাবে – কী করা যায় এখন?

এই সময়টা মার্চ মাসের শেষ দিকেই হবে, আপিসে বেজায় কাজের চাপ; বছরের শেষ ব’লে কথা – কাজের দেশে বসন্ত আসে না। কিন্তু তিনি এলেন – রাণাদা, বন্ধু রাণা ওরফে কৌস্তভ সরকার এক সন্ধ্যেয় হঠাত্‍ আমার বাসায় এসে হাজির হলেন বৈশাখী ঝড়ের মত। আমি যাকে সন্ধ্যে বললাম, অনায়াসেই তাকে রাত ব’লে ফেলবেন অনেকে; কেননা ঘড়ির হিসেবে সম্ভবতঃ সোয়া দশটা বেজে গিয়েছে ততক্ষণে। কিন্তু আমাদের আনাগোনা ওইরকমই।

আপিসের পোশাক ছেড়ে নিজের পোশাক পরতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। পোশাক কথাটা পোশাকী অর্থেই বলছি – আমার আমিটা যেই পেশার আমির থেকে মুক্তি পেয়ে দিনের শেষে আদত আমিটার কাছে এল, অমনি তার প্রশ্ন করা শুরু – ‘এখন কী করা যায়’? ধুত্তোর!

এর মধ্যে আবার ক’দিন পরে একটা অনুষ্ঠানে বাজাতে যাবার কথা! কিন্তু আপিসের নাভিশ্বাস পরিস্থিতিতে এমন বিক্ষিপ্ত মনের অবস্থা, এর মধ্যে দাঁড়িয়ে কী যে ছাই বাজাব কিছুই ঠিক ক’রে উঠতে পারছি না। রাণাদা এসে পড়ায় ভাল লাগলো, আর কিছু না; দুই বন্ধুতে দুটো ইন্সট্রুমেন্ট হাতে নিয়ে একসাথে কিছুক্ষণ বাজালেই যথেষ্ট বিনিময় হবে। যেটা চাইছিলাম, সেটা নেহাত ভার্বাল শেয়ারিং নয়।

চোখ বন্ধ করলেই ফুটপাথের সেই ছড়ানো আগুন ভেসে উঠছিল। আর ক’দিনই বা? বসন্ত এবার চলল ব’লে। না ব’লেই এসেছিল আবার না ব’লেই বিদায় নেবে। আমার আর কিছুই করা হয়ে উঠবে না। সব আলো বড় তাড়াতাড়ি নিবে আসে। তাড়াতাড়ি ঝরে যায় সব ফুল…

রবীন্দ্রনাথের ‘চ’লে যায় মরি হায়’ গানটা আমরা সেদিন বাজাচ্ছিলাম দুজনে। আমি হারমোনিকা, আর রাণাদা পিয়ানো। আসল পিয়ানো আর কোথায়, আমার মিডি কীবোর্ডই ভিএসটি সমভিব্যাহারে রাণাদার হাতে সেদিন পিয়ানো হয়ে উঠেছিল। বাজাতে বাজাতে কখন ঘড়িতে রাত্তির সাড়ে বারোটা বেজে গেল। আমি ভাবছিলাম, ওই অনুষ্ঠানে এই গানটাও বাজালে বেশ হয়; আর তাই রেকর্ড করে রাখছিলাম আমাদের বাজনাটা। রেকর্ড করার সুবিধে হল, পরে শুনলে নিজের অনেক গলদ বোঝা যায়; যেটা মেরামত ক’রে নেবার একটা সুযোগ পাওয়া যায়। অথচ যেদিন অনুষ্ঠান হল, সেদিন আর এটা বাজানো হয়নি। না হোক, তবু হার্ড ডিস্কের আরেকটা ফাইল হয়ে থেকে গিয়েছিল আমাদের সেই স্বতঃস্ফূর্ত সাংগীতিক আদান-প্রদান।

দেখতে দেখতে মার্চ শেষ হয়ে এপ্রিল এল – এপ্রিলও যাই যাই করছে এমন একটা সময়ে আমার হঠাত্‍ ইচ্ছে হওয়া শুরু হল, যে গানটাকে ঠিকঠাক ভাবে অ্যারেঞ্জ করে রেকর্ড করি। এখন ‘ঠিকঠাক ভাবে অ্যারেঞ্জ করি’ বললেই তো আর হয় না! বাধ সাধলেন ভি বালসারা। কী কাজ যে ক’রে রেখে দিয়েছেন ভদ্রলোক! দুত্তেরিকা!

গানটা এমনিতেই দুর্দান্ত। কী ভাবে যে ওরকম একটা সুর করা যায় জানি না! অত ইনফরমেটিভ, স্মার্ট একটা মেলোডি সারা পৃথিবীতে বোধহয় একটাই রচিত হয়েছিল। আর সেটা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এই গানটার সঞ্চারীতে এসে। তবে এটা নিতান্তই আমার মনে হওয়া।

আমি মনে মনে স্পষ্ট দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথ এই গানের সুরটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা ভেবেই তৈরি করছেন। ‘সা’ থেকে উঠে ‘মা’ তে দাঁড়িয়ে ‘মরি হায়’ বলা কিম্বা সোজা সাপটা সুর লাগিয়ে লাগিয়ে ‘ফাল্গুনের তাপে’র ধারাবিবরণী দেওয়া – এটা পারার জন্যে তো একটা ‘পুরুষকণ্ঠ’ চাই! আর একজনও পারেননি এটা ওভাবে গাইতে। অন্ততঃ আমি তো শুনিনি।

‘সা’ থেকে ‘মা’ ব’লে ফেললাম বটে, আমার কিন্তু খালি মনে হয় ওটা মন্দ্র সপ্তকের ‘পা’ থেকে ‘সা’ তে এসে দাঁড়ানোর একটা ছল। সে স্বরবিতান যাই বলুক। এ গানটাতে ও বই মেনে ‘মধ্যমকে’ টোনিক করলে যে স্বরবিন্যাস দাঁড়ায়, তাতে ‘কোমল নি’ এসে পড়ে চতুর্থ হিসেবে। আর ‘কোমল নি’ লাগিয়ে গাইতে গেলে এমনকি কল্পনাতেও সুরটা যেন একটু বেশি নরম হয়ে গিয়ে শেষমেশ ‘নাইনিতালের নতুন আলু’র মতন ‘আলুলায়িত’ হয়ে দাঁড়ায়। সে দিক থেকে ‘শুদ্ধ মধ্যমের’ চেহারা অনেক বেশি স্মার্ট। বিশেষ করে স্বর বিন্যাসে ‘কড়ি মা’ আসার পরে যদি তিনি আসেন – তো রাজার মত আসেন। কাজেই ‘সা’ কে ‘সুর’ ধরলেই এ গানের মেজাজটা বেশি লাগসই হয় যেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের ক্ষেত্রেই এই কথাটা আমার অশিক্ষিত মাথায় আনাগোনা করেছে। অনেকেই হয়ত বলবেন – ‘কিন্তু সুরটা (মেলোডি) তো একই থাকছে’ – হ্যাঁ থাকছে। যা বলছি সেটা তাহলে নেহাত কাল্পনিক ব্যাপার? হবেও বা। কিন্তু মনের ভেতরে এক একটা স্বরের একেকটা আলাদা আলাদা ছবি আঁকা থাকে না? আমার তো থাকে বাপু।

সে যাই হোক – ভি বালসারার কথা বলতে শুরু করেছিলাম। আধুনিক বাংলা গানে আর কোনও যন্ত্রশিল্পী আমাকে এতখানি প্রভাবিত করেননি যতটা বালসারা সাহেব করেছেন। করবেন না? ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি, ছেলেবেলা থেকে যে বিপুল সংখ্যক বাংলা গান শুনতে শুনতে আর ভালোবাসতে বাসতে জীবনের এতগুলো দিন কাটিয়ে দিলাম, তার প্রায় নব্বই শতাংশ গানের রেকর্ডিংএ কোনও না কোনও যন্ত্র হাতে হাজির ছিলেন এই সুন্দর, সুরসিক, সহজ আর সুগভীর মানুষটি। উত্তমকুমারের সিনেমায় দেখছি মহানায়ক চোখের সামনে নড়াচড়া করছেন, অভিনয় করছেন, সংলাপ বলছেন – কিন্তু নেপথ্যে বোবা কান্নার মত ইউনিভক্স বেজে উঠলেই নায়িকা সমেত উত্তমকুমার হাওয়া। ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যালরাও আর বিলকুল নেই! ওই পার্সি বুড়োর হাসি হাসি মুখটা চোখের সামনে সমানে ভেসে উঠছে – বাজনার অতল গভীরে যখন থাকতেন, চোয়ালটা একটু ঝুলে পড়ত যেন। গানের শরীরে তাঁর পিয়ানো বাজানোর একটা বিশেষ আঙ্গিক ছিল। পিয়ানোর হাই অক্টেভে কী যেন একটা মায়াময় আলতো কর্ড মেশানো স্বরের ঢেউ তুলতেন, যেটা গানের মূল সুরটার ইঙ্গিত বহন করতো কখনো কখনো, কিন্তু ঠিক সং লাইন হয়ে উঠত না কোনও সময়েই। সুরটার সাথে লুকোচুরি খেলতো তাঁর পিয়ানো। এটা আর কেউ পারেননি, করেনও নি। একটা সুদীর্ঘ সময়কাল ধ’রে যে মর্মধ্বনি তিনি বাংলা গানকে দিয়ে গিয়েছেন তার হিসেব, কেউ রাখেওনি আর রাখবেও না।

ভূপেন হাজারিকা গত হবার পরে কবীর সুমন তাঁকে নিয়ে একখানা গান বাঁধেন; যার একটা লাইন ছিল ‘জানতেন তিনি গানের বানান’। ভি বালসারাও কিন্তু সত্যি সত্যি গানের বানান জানা একজন মানুষ।

কবীর সুমনের কথা বলতে গিয়ে মনে প’ড়ে গেল একটা সন্ধ্যে – ভি বালসারা তখনও সশরীরে বেঁচে, তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। আমি দর্শকাসনে। যদ্দূর মনে পড়ছে, সেটা ছিল ক্যালকাটা সিনে মিউজিশিয়ান্স অ্যাসোশিয়েশনের একটা অনুষ্ঠানের এক্কেবারে শেষ গান; মঞ্চের মাঝখানে ব’সে গিটার বাজিয়ে কবীর সুমন যাঁকে নিয়ে সদ্য বাঁধা একটা গান গাইছেন, সেই তিনিই মঞ্চের বাঁদিকে রাখা একটা ডালা-তোলা গ্র্যান্ড পিয়ানো বাজিয়ে চলেছেন সে গানের অনুষঙ্গে। গানটায় সুমন লিখেছিলেন ‘স্বরলিপি ক’রে রাখা অর্কেস্ট্রার যন্ত্রণা/রবীন্দ্রনাথ তাঁর কানে কানে দেন মন্ত্রণা/স্বরচিত সুরে তাঁর কল্যাণ ঠাট খেলা করে’। রতনে রতন চেনে।

এই মানুষটার ভাবনায় ‘চ’লে যায় মরি হায়’ এমন একটা জিনিস, ওই পলাশ গাছটার থেকেও যেটা সাংঘাতিক। রবীন্দ্রনাথের গানে এমন তীক্ষ্ণধী ইন্টারল্যুড আমি বড় একটা শুনিনি। সুরটার ইন্টারেস্টিং একটা বাঁকে এসে শুদ্ধ আর কোমল দুটো ‘নি’ কে (যাদের আমি বলছি তীব্র আর শুদ্ধ মধ্যম) পাশাপাশি রেখে রবীন্দ্রনাথ যে ব্রিলিয়ান্ট ‘কল্যাণ ঠাটের খেলা’টা খেলেছেন, ইন্টারল্যুডে সেটাকেই জাস্ট আন্ডারলাইন ক’রে দিয়েছেন বালসারা সাহেব। অথচ কী গভীর তার অভিব্যক্তি! কী সংক্ষিপ্ত সেই প্রকাশ। ওর থেকে পার পাবার জো আছে?

পেলাম না পার। গানটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ক্রমশ মনে হতে লাগলো ওটাই সত্যি – জগত্‍ মিথ্যে। চেষ্টা করলাম তাঁর অ্যারেঞ্জমেন্টটাকে ডিজিটালি পুনর্নির্মাণ করার। তবলা, মন্দিরা, পিয়ানো, এক্যুস্টিক গিটার, ডবল বেস আর ইউনিভক্স। মোটামুটি ভাবে এই ছিল তাঁর মশলাপাতি। দেখা দেখি আমিও তবলার প্যাটার্ন বানালাম। তবে বালসারা সাহেবের মত ২/৪ এ না গিয়ে ৪/৪ ক’রে ফেললাম। আসলে, ‘আসল তবলা’ তো আর বাজাচ্ছি না, ছোট প্যাটার্ন খুব যান্ত্রিক শোনাবে ভেবে গতরে তো বাড়িয়ে নিলাম, কিন্তু হেমন্তবাবুর কায়দায় একটা বাড়তি ‘বার’ যোগ করার চেষ্টা করতে গিয়ে হ’ল গলদঘর্ম অবস্থা। কী কান্ড! তাল উল্টে যাচ্ছে! এটা তো খেয়াল ক’রে দেখিনি! অগত্যা কপিবুক। ফ্রন্টফুটে এসে ডিফেন্স করতে হল।

ইন্টারল্যুডে যে সুর বেজেছে, ও জিনিস ভিএসটি টোন দিয়ে করতে গেলে পুরোটা মাঠে মারা যাবে। তাই ইউনিভক্সের জায়গায় বাজালাম মেলোডিকা। কী মেধাবী ইন্টারল্যুড রে বাবা! বাজাতেও যে কী ভাল লাগে! বালসারা সাহেবের এরকমই আরেকখানা মাস্টারপিস ভাবনার পরিচয় পেয়েছিলাম হেমন্তবাবুরই গাওয়া ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো’ শুরু হওয়ার আগে পিয়ানোতে বাজানো অতিসংক্ষিপ্ত সুরটা শুনে – সন্দেহ নেই আমার শোনা একটা সেরা প্রিল্যুড মিউজিক সেটা। কোনদিন যদি সে গানটা রেকর্ড করার কথা ভাবি তো আমি নিশ্চিত, ওই মিউজিকটা এড়ানোও আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

যাই হোক, ব্যাপারটা সুরে তালে মোটামুটি দাঁড়াল। এখানে বলে রাখা দরকার, সেদিন রাণাদার বাজানো পিয়ানো খুব সাহায্য করেছে এই কাজটা করতে। কর্ড পরম্পরায় ওঁর দেখানো রাস্তা দিয়েই হেঁটেছি মোটামুটি ভাবে। কর্ডস নিয়ে খেলতে উনি আবার দারুন ওস্তাদ।

আমি আমার মত ক’রে করলে অনেক সিম্পল হতো ব্যাপারটা। পরে অবশ্য শুনে দেখছি কোনও কোনও জায়গায় সেটা হলে নেহাত মন্দ হত না। বেশি কর্ডের পরিবর্তন কোথাও কোথাও সুরের সহজ মেজাজটাকে বিক্ষিপ্ত করে।

গানটার প্রাথমিক অ্যারেঞ্জমেণ্টের কাজ হয়ে যাবার পরেও মাথার ভেতর আরও কী কী যেন আসছিল। একদিন দুপুরে আপিস থেকে কাজের ফাঁকেই অভ্রকে ফোনে ধরলাম। তিনি তখন স্কুলে। ক্লাস নিচ্ছিলেন না ভাগ্যিস।

– “বালসারা সাহেবের অর্কেস্ট্রেশনের সাথে বেহালার বৃন্দবাদনে একটা ওব্লিগাটো জুড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে গানের বডি তে? অথবা জাস্ট গম্ভীর একখানা চেলো লাইন? কি বলো?”

– “ক’রে দেখতে পারিস। গানটায় অনেক স্কোপ আছে… দ্যাখ কি’রম শোনায়।”

– “ওটাই তো মুশকিল! পৃথিবীর সমস্ত ভাল কম্পোজিশনেই অনেকগুলো ক’রে স্কোপ থাকে… কিন্তু… খারাপ লাগবে বলো? সিম্পলিসিটিটা নষ্ট হয়ে যাবেনা?”

– “বলছি তো… দ্যাখ না ক’রে! খারাপ লাগলে ওই ট্র্যাকগুলো বাদ দিয়ে মিক্স করিস।”

ভায়োলিন, চেলো – সব মাথাতেই থাকলো। মাথায় থাকলেন বালসারা সাহেব, হেমন্তবাবু আর রবীন্দ্রনাথ। আপিসে এমন চাপ এল যে সমস্ত দিন-রাত এক ক’রেও কূল পাওয়া যায় না। সাতদিন গেল, দশদিন গেল, বারো দিন গেল – আমার তো এদিকে হাঁকপাঁক অবস্থা। শরীর ভেঙে আসছে ক্লান্তিতে। আর মন পড়ে আছে ‘দূর শাখে’।

কিন্তু সেখানে ‘পিক’ ডাকল না। ডাকল ‘পিকোলো’। ফের যখন রাত্তির-টাত্তির জেগে গানটা নিয়ে বসতে পারলাম; নতুন শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই অন্য রকম সব আইডিয়া মাথায় আসতে লাগলো। আইডিয়া এলেই যে সেটা ভাল আইডিয়া হবে তার তো কোনও মানে নেই, কিন্তু তবু ক’রে দেখতে তো বাধা নেই। চেষ্টা ক’রে যেতে লাগলাম গানটা নিয়ে। কয়েক রকমের বেহালা, চেলো, পিকোলো পাতে এসব মণ্ডা মিঠাই পড়তেই অন্য একটা রস পেয়ে বসল আমাকে।

আমি তখন অনে-ক ছোট, এক ইতালীয় ভদ্রলোকের কথা, বোধহয় প্রথম শুনেছিলাম দাদাভাইয়ের (আমার ঠাকুর্দা) কাছে; তাঁর নাম ফ্রান্সিসকো ক্যাসানোভা। ফ্লুট আর পিকোলো বাজাতেন। মিউজিক অ্যারেঞ্জ করতেন, অর্কেস্ট্রা কনডাক্টও করতেন। উনিশ’শ চল্লিশ–একচল্লিশ সাল নাগাদ কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলে এক অনুষ্ঠানে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের সুরের সঙ্গে তিনি অর্কেস্ট্রা রচনা করেছিলেন। ‘গানে’ না ব’লে ‘রবীন্দ্রনাথের সুরে’ বললাম এইজন্যে, যে ভাষাটা ছিল হিন্দী। যে গানের রেকর্ডও বেরিয়েছিল। আমি দুটো গান শুনেছিলাম – ‘ইয়াদ আয়ে কী না আয়ে তুমহারে’ আর ‘প্রাণ চাহে নয়না না চাহে’। বলা বাহুল্য ‘মনে রবে কি না রবে’ আর ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’।

যেমন গলা, তেমন অর্কেস্ট্রা! শুনে মনে হয়েছিল – কী শুনলাম! এইরকম বিচিত্র সম্ভাবনা লুকোনো ছিল রবীন্দ্রনাথের গানে! ডবল বেসের আওয়াজটা যেন ঘন মেঘের ওপারের বাসিন্দা! অপার বিস্ময়। এত বছর আগে দুই যুগপুরুষ সেটা ধরতে পেরেছিলেন, কিন্তু তার পরেও এই ভদ্রলোকের গানের জায়গা হয়েছে শুধু এসরাজে, তানপুরায়, তবলায়, বিধিনিষেধে, সার্ধশতবর্ষে আর ট্রাফিক সিগনালে। কেউ কেউ যে অন্যরকম চেষ্টা করেননি তা নয়, কিন্তু বাঙালি নিতে অস্বীকার করেছে। বালসারা সাহেবের মুখে শুনেছি, অনেক কাল আগে নাকি ‘বসুশ্রী’ সিনেমা হলে ডঃ পার্থ ঘোষের সিম্ফনী অর্কেস্ট্রার সাথে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসংগীত গাইবার জন্যে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। প্রথম গান হতে না হতেই শ্রোতারা রিঅ্যাক্ট করা শুরু করেন। সেই রিয়্যাকশন গোলমাল অবধি পৌঁছয়। আর শেষ পর্যন্ত হেমন্তবাবুকে অর্কেস্ট্রা ছাড়া শুধু হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করতে বাধ্য করা হয়। ভাবলেই লজ্জা লাগে। বাঙালি নাকি কালচারের বড়াই করে। এটা কোনও সভ্য জাতির লক্ষণ হতে পারে না।

এদিকে ‘সংগীত চিন্তায়’ পড়ছি – রবীন্দ্রনাথ দিলীপকুমার রায়কে বলছেন – “আমি তো একবার তোমার পিতার গানের সম্বন্ধে লিখেছিলাম যে, তাঁর গানের মধ্যেও য়ুরোপীয় আমেজ যদি কিছু এসে থাকে তবে তাতে দোষের কিছু থাকতে পারে না, যদি তার মধ্য দিয়ে একটা নূতন রস ফুটে উঠে বাঙালির রূপ গ্রহণ করে। আর দেখো য়ুরোপীয় সভ্যতা আমাদের দুয়ারে এসেছে ও আমাদের পাশে শতবর্ষ বিরাজ করেছে। আমি বলি – আমরা কি পাথর না বর্বর, যে, তার উপহারের ডালি প্রত্যাখ্যান করে চলে যাওয়াই আমাদের ধর্ম হয়ে উঠবে? যদি একান্ত অবিমিশ্রতাকেই গৌরবের বিষয় বলে গণ্য করা হয়, তা হলে বনমানুষের গৌরব মানুষের গৌরবের চেয়ে বড়ো হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, মানুষের মধ্যেই মিশেল চলছে, বনমানুষের মধ্যে মিশেল নেই।”

এই দেশে যে শেষ পর্যন্ত ট্রাফিক সিগনালে তাঁর জায়গা হবে তাতে আর আশ্চর্য কী!

যাক গে, ক্যাসানোভা সাহেব আর পঙ্কজ কুমার মল্লিককে নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম, সেইটা বলি। সত্যি মিথ্যে জানি না। তবে, সত্যি যদি নাও হয়ে থাকে; এই মাপের মানুষদের এই রকম সব কাজ নিয়েই তো ‘সংগীতের দেশে’ লোকগাথার জন্ম হবার কথা… তাতে দোষের কিছু নেই।

‘প্রাণ চাহে নয়না না চাহে’র অর্কেস্ট্রেশনের কাজ তখন চলছে। ক্যাসানোভা যাই করছেন পঙ্কজবাবুর ঠিক মনের মতন হচ্ছে না। তাঁর মনে হচ্ছিল, ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’ – রবীন্দ্রনাথের গানের এই সহজ মর্মকথা ক্যাসানোভা সাহেবের মাথায় ঢুকছে না; তাই কী করে সাহেবকে ব্যাপারটা বোঝানো যায় তাই নিয়ে ক’দিন থেকেই ভাবিত ছিলেন তিনি। একবার দুজনে একসাথে ট্রেনে চেপে কোথাও একটা যাচ্ছেন। এক স্টেশনে ট্রেন থেমেছে এবং সেখান থেকে কামরায় উঠেছেন এক পরমাসুন্দরী ইউরোপীয়া, যিনি আবার এই দুই সংগীতকারের সামনের সিটে এসেই বসেছেন ঘটনাচক্রে। চোখ ফেরানো যায় না এমনি ধারা রূপ তাঁর। ক্যাসানোভা তো তাঁর দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারছেন না, এদিকে আবার সরাসরি তাকাতেও সম্ভ্রমে বাধছে। যাচ্ছেতাই অবস্থা সাহেবের। তাঁর মনের অবস্থা আঁচ করে পঙ্কজবাবু বললেন: “মিস্টার ক্যাসানোভা, আই থিংক নাউ ইউ ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড এগজ্যাক্টলি হোয়াট কবিগুরু ইজ ট্রাইং টু এক্সপ্রেস!”

বাট, হোয়াট আই ওয়াজ ট্রাইং টু এক্সপ্রেস থ্রু ‘চ’লে যায় মরি হায়’ অ্যাট দি লেটার স্টেজ, বুঝলাম সেই ভাবনাটা আসলে মনে গেঁথে দিয়েছিলেন ক্যাসানোভা সাহেবই। হয়ে যাবার পরে কিন্তু আর তেমন ভাল লাগলো না। দেখলাম দুটো একসঙ্গে যাচ্ছে না। ভি বালসারার দেখানো পথটাই বেশি ভাল লাগলো। তার ওপরে বাড়তি যন্ত্রের বোঝা ভাল লাগলো না। “সূর্যাস্তেও চাপাবে উপরি রঙ? শিশুর মুখের সরলতা এঁকে বাড়াবে?”

দুটোকে আলাদা করে দিলাম। একই গানের দু রকম অ্যারেঞ্জমেন্ট করলাম। হারমোনিকাটা বাজিয়ে ফেলার পরে অভ্রকে দুটোই শোনালাম। গানবাজনার ব্যপারে ওর সাথেই রিলেট করতে পারি সবচাইতে বেশি। দেখলাম বরাবরের মত ও আমার সাথে একমত। ওরও মতে প্রথমটাই ভাল। আপিসের এক সহকর্মীর মতও দেখলাম তাই। দ্বিতীয়টা জবরজং লাগছে। হারমোনিকায় গানের ‘লীড’ সুরটা, যেটা শ্রোতার কানে কথার খেই ধরিয়ে দিচ্ছে, সেটা সাম হাউ একাধিক বোয়িং ইন্সট্রুমেন্ট এর টানা শব্দের তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে। অর্থাত্‍ কথা একটা ইমপর্ট্যান্ট ফ্যাক্টর।

এবারে হল আর একটা মজা। তিন অবাঙালি বন্ধুর সাথেও শেয়ার করলাম দুটো অ্যারেঞ্জমেন্ট। এঁরা কেউই কলকাতা বা বাংলার বাসিন্দা নন। বাংলা জানেনও না। একজন দক্ষিণের, একজন মধ্য ভারতের আর একজন ম্যাপের ওপরের দিককার বাসিন্দা। এঁরা সকলেই দেখলাম অর্কেস্ট্রাল ভারশানটার পক্ষে। অর্থাত্‍ সুরও একটা ইমপর্ট্যান্ট ফ্যাক্টর।

ভেবে দেখছি, যাঁরা গানটার সাথে পরিচিত, কথাগুলোও জানেন মোটামুটি, তারা সেটাকেই মনে মনে পুনরুচ্চারণ করতে চাইছেন। আর যাঁরা অবাঙালী, তাঁরা শুনছেন শুধু একটা ‘কথা নিরপেক্ষ’ সুর। কথার ফ্যাক্টরটা তাঁদের ক্ষেত্রে কাজই করছে না, তাই তাঁরা সুরটাকেই বেশি করে পেতে চাইছেন। বাহুল্য সমেত। ‘সুরের মিতবাচন’ কথার ইঙ্গিতে বাঙ্ময় হয়ে উঠছে। কিন্তু অর্থ ছাড়া ‘মিতবাচন’এর মানে হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘সাদামাটা’। একই কারণে হয়ত আমার কাছেও প্রথমটাই বেশি অর্থবহ, দ্বিতীয়টা বাহুল্য।

এই ভাবনার থেকে দুটো প্রচেষ্টাকেই শেয়ার করছি সকলের সাথেই। এই কাজটা দেখার নয়, শুধু শোনার – অথবা শোনার ভেতর দিয়ে দেখার। ইচ্ছে করেই তাই নিছক দুটো কম্পোজিশন শোনা ছাড়া শ্রোতার অন্য কোনও এনগেজমেন্ট রাখতে চাইলাম না। ফলে বরাবরের মত ‘আমায় দেখো মার্কা’ ভিডিও-ও বানালাম না। দুটো ভিন্ন প্রেক্ষিতে সুরটা পরপর দুবার দুভাবে সাজিয়ে দিলাম। মাঝে শুধু (অবাঙালি বন্ধুদের খাতিরে ইংরিজিতে) সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলার জন্যে বিশেষ ক’রে দুই বরণীয় শিল্পীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর তাগিদে ক্যামেরার সামনে হাজির হয়েছি। নেহাত মোবাইলের ক্যামেরাতেই তুলেছি সে ছবি।

আমার নিজের বিবেচনা এতক্ষণে আপনারা জেনে গেছেন। আপনাদের বিবেচনা জানার জন্যে ইচ্ছে রইল।

দেখুন দেখি! গত কদিন ধ’রে চলতে থাকা এই লেখাটা শেষ করতে করতে দেখছি ঘটনাচক্রে আজ পঁচিশে বৈশাখ। যদ্দুর মনে পড়ছে, এই রকম একটা ঘটনাচক্র গেলবার বাইশে শ্রাবণের দিনেও ঘটেছিল।

হ্যাপি বার্থডে রবীন্দ্রনাথ! – আপনার জন্যেই এত কান্ড!

৯ মে, বৃহস্পতিবার। ২০১৩
দমদম ক্যান্টনমেন্ট

Comments
3 Responses to “ফাল্গুনের তাপে [Phalguner Taape]”
  1. Rama Chaudhuri says:

    সুমন্ত,
    বেলভিউ নার্সিংহোমের উল্টোদিকের রাস্তায় পলাশ গাছটা আমার চেনা। আর একটু এগিয়ে একটা বকুলও। আর পার্কের মধ্যে দুটো মহুয়াও আমায় সঙ্গ দেয়। কর্মসূত্রে বেলভিউ’র পাতালে নেমে যাওয়ার আগে গাছগুলোকে দেখে নিই। সন্ধ্যেবেলার অন্ধকারে আবার ওদের দেখি। ততক্ষণে ঝুপসি হয়েছে চারপাশ। তেমন স্পষ্ট বোঝা যায় না। রাস্তা পার হয়ে ওপারে গেলে পলাশের কাছে দাঁড়াই, কিংবা বকুলের নিচে। আবোলতাবোল হাওয়ায় ফুল ঝরে পড়ে গায়ে মাথায়। ওপাশে মহুয়ার ফুল পড়ে থাকে ফুটপাথে। একবারও না তাকিয়ে পায়ে মাড়িয়ে চলে যায় মানুষ। আমি একটা দুটো খুঁজে খুঁজে তুলি। তীব্র গন্ধের ভাপ পেছনে টানে। স্মৃতির ছবির সঙ্গে সঙ্গত দেয়।

    আজ আপনার বাজনা শুনলাম। বেশ কয়েকবার। প্রথমটা বেশ শান্ত পায়ে চলেছে। ফাল্গুন ফুটে উঠছে। কোমল, করুণ। কিন্তু দ্বিতীয়টা আমায় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল। সঙ্গীতের ভাল-মন্দ বোঝার ক্ষেত্রে আমাকে মূর্খই বলা যায়। অনুভবে যেটুকু বলে শুধু সেটুকুই বুঝি। আপনার দ্বিতীয় বাজনাটা ওই পলাশ গাছের সঙ্গে মিলে গেল। ওটায় ‘বসন্ত’ এল। তীব্র, আকুল, নির্মম, উদাসীন। ফুল ফোটানো আর ঝরানোয় একইরকম আনন্দ। রূপ আর নিস্পৃহতার অহঙ্কার যেমন হয়, যতটা আসক্তিতে আঁকড়ে ধরার আবেশ, ঠিক ততটাই উদাসীন চলে যাওয়ার আনন্দ স্পর্শ করল। কি জানি কিছু বোঝাতে পারলাম কি না! কিন্তু এরকমই মনে হল, তাই লিখলাম। অনেক সমঝদার বোদ্ধা আপনাকে ঠিক ঠিক জানাবেন নিশ্চয়ই। তবে শ্রোতার রকমফেরে আমিও তো একরকম, তাই না?

    ভালো থাকুন। আবারও সুরের অপেক্ষায় রইলাম…

    • Sumanta Basu says:

      রমা দি,

      আপনার মন্তব্য প’ড়ে কী যে ভাল লাগলো। কত সুন্দর ক’রে যে লেখেন আপনি। ফুল ফোটানো আর ঝরানোয় একই রকম আনন্দ – এ কথা সবাই বলতে পারে না। ফুল যাঁর হাতে ফোটে, ঝরেও – এ কেবল তাঁকেই মানায়। যিনি কেবল সে ফুলের বর্ণগন্ধের রসগ্রাহী, ঝ’রে যাওয়ার অনন্ত আনন্দ তাঁর বোঝার নয়।

      আপনার কথা ভাবনা টেনে আনে।
      ভাল থাকবেন। ভালোবাসা জানবেন।

      – সুমন্ত

  2. Jayanth from Bangalore says:

    So sad I know not Hindi to read your Hindi/Bengali writings !

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

  • Blog Stats

    • 19,879 hits
  • Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

    Join 22 other subscribers
%d bloggers like this: