দুর্গা

আজ একজন অদ্ভূত মানুষের গল্প বলব। অনেক দিন থেকেই ভাবছি; এবারে বলতেই হবে। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব ভাবতে ভাবতে ক্রমশঃ পেছনে চলে যাচ্ছি। কথার টানে কথা আসছে। এ বড় বাজে ব্যামো।

কোথায় ইচ্ছে ছিল আর্ট কলেজে ভর্তি হব, সে বিষয়েই পড়াশুনো করব – কিন্তু সেটা ইচ্ছেই থেকে গেল। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে যেটুকু সহজাত দক্ষতা ছিল, তাই নিয়ে আর যাই হোক পেশাদার গ্রাফিক ডিজাইনার হবার কথা আমার ছিল না (আসলে কিছুই যে হবার কথা ছিল না – সেটা এখন বুঝি)। এ পেশায় এসে পড়াটা নেহাত একটা অ্যাক্সিডেন্ট। কাজগুলোকে সিরিয়াসলি নিলেও জীবনটাকে সিরিয়াসলি নিইনি জীবনে। পেশার একটা দরকার ছিল খুব, কারণ দারুন স্বচ্ছলতার মধ্যে ছেলেবেলা কাটেনি। কিন্তু সে পেশা কী হতে পারে, তা আমার দুর্ভাবনার চৌহদ্দিতেও ছিল না।

ক্রমশঃ যখন বুঝতে পারছিলাম, ছবি আঁকা আর এ জীবনে হয়ে উঠবে না, ছেলেবেলাকার আরেক প্রেম; সংগীতের দিকে ততদিনে মন আপনা হতেই ঢলে পড়েছে। একটা মাধ্যম আসলে বেজায় দরকার হয়ে পড়েছিল। টাকা উপায় করার জন্যে নয়; স্রেফ কমিউনিকেট করার জন্যে। আর একটা আত্মিক সম্বল অবিশ্যি ছিল। তা হল লেখা। যা ছিল প্রেম, ক্ষত, অসহায়তা, শান্তি, অশান্তি, অক্ষমতা, রাগ, বিস্ময়, অভিমান, ঈর্ষা, ভালোলাগা, আবিষ্কার, আঘাত, জ্বালা – কেউ যদি সে সব একান্তই অকপট জেনে থাকেন, তো এই ভাষার বর্ণমালাই জানেন।

ঠিক করেছিলাম পেশাকে রাখবো পেশার জায়গায়, আর নিজেকে নিজের। পেশার যে একটা নিজস্ব ডায়নামিজম আছে, ঘাঁত্‍ ঘোঁত্‍ আছে, চাহিদা আছে, দখলদারী আছে – পেশা জীবনের শুরুর দিকে সেটা বুঝিনি; আসলে বুঝতে চাইনি। অস্বীকার করেছিলাম; তারুণ্যের ধর্মই ওই। ক্রমশঃ দ্বন্দ্বটা প্রকট হতে লাগল। তীব্র হতে লাগল আত্মিক অনটন। এদিকে ছেলেবেলা থেকে দেখা কলকাতাটাও খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছিল। পাল্টে যাচ্ছিল সমস্ত কিছু। ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মানুষজন, তাঁদের ভাষা, ব্যবহার, রুচি, মূল্যবোধ – সব কিছুই বদলাচ্ছিল খুব দ্রুত। নিজেকে বড্ড অ্যালিয়েনেটেড লাগছিল। নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয় ভাগটা এক ধাক্কায় বদলে দিয়েছিল সবকিছু। সেখানে আমি; কেন জানি থেকে গেলাম অনেক অনেক পেছনে। প্রাকপুরাণিক বাল্যবন্ধু যত; বিগত সবাই। আমি? অসহায়। একা।

যাক গে। ফাটা ডিমে তা দিয়ে আর কী লাভ, এ নেহাতই একটা সময়ের বর্ণনা – মনস্তাপ নয় ঠিক; অন্ততঃ এই মুহূর্তে।

এইরকম একটা সময়ে জীবনযাত্রা ছিল অন্যরকম। আপিস ছুটির পরে মাইলের পর মাইল হাঁটতাম। রোজ। একা একা। বদলাতে থাকা কলকাতাটার নানান গলিঘুঁজির ভেতরে দিশেহীন টো টো, আর নানান মানুষের সাথে গায়ে পড়ে আলাপ জমানো ছিল আদপে নিজেকেই খুঁজে ফেরা। কোনও এক সন্ধ্যেয়, কোনও এক টুকরো কলকাতায়, কোনও এক গ্রাম থেকে রোজগারের আশায় চলে আসা কোনও এক বিহারী চা-ওয়ালার খাটিয়ায় বসে তাঁর সাথে; আসলে নিজের সাথেই কথা বলা – এসব ছিল নিত্যদিনের কাজ। এ কলকাতার মধ্যে থাকা আরেকটা কলকাতার সেই ছবিটা হেঁটে দেখতে শেখার খুন পুরোপুরি চেপে গিয়েছিল মাথায়।

আমাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা কম কথার মানুষ বলেই জানেন। ঠিকই জানেন। কারুর সাথে যেচে, গায়ে পড়ে আলাপ – ঠিক আমার চরিত্রানুগ নয়। পেশা ইদানিং একটু বাচালতা শিখিয়েছে, অস্বীকার করব না। কিন্তু সঙ্গে দিয়েছে অন্তহীন এক ক্লান্তিও। অথচ তখন – কী আশ্চর্য; ক্লান্তি আসত না মোটে! কী এত গল্প করতাম? ভেবে দেখলে, নেহাতই এটা সেটা। হয়ত তুলে আনার চেষ্টা করতাম নানান টুকরো কথা, প্রকাশভঙ্গী। এমনকি সংগীতও।

ঠিক এরকম একটা সময়েই আমার আলাপ সেই মানুষটার সঙ্গে। যাঁর কথা বলব বলে স্মৃতি কাঁচিয়ে নিজেকে খুঁজছি। আসলে মানুষটা বোধহয় আমার থেকে বড় একটা আলাদা নন।

তখন নিক্কো কোম্পানিতে চাকরি করি। ডালহৌসির নিক্কো হাউসে আপিস। প্রায়দিনই সন্ধ্যেবেলা হাঁটা লাগাই ধরমতলা লক্ষ্য করে। সেখান থেকে লিন্ডসে স্ট্রীট, পার্ক স্ট্রীট, কিড স্ট্রীট, ফ্রী স্কুল স্ট্রীট যেদিন যেখানে ইচ্ছে।

এখানে বলে রাখি, ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের প্রতি বিশেষ আকর্ষণের একটা কারণ ছিল। আজ যেটা ‘যমুনা ব্যাঙ্কোয়েট’ হল, তখন ছিল ‘যমুনা সিনেমা’। আর তার উল্টোদিকেই; সম্ভবতঃ কলকাতার সবচাইতে পুরোনো বাজনার দোকান – ‘ব্র্যাগাঞ্জা এন্ড কোম্পানী’, আর তার লাগোয়া ‘ক্যালকাটা পিয়ানো শপ’। পিয়ানো ব্যাপারটাই কেমন একটা স্বপ্নের মত। বাজাতে পারিনা বটে, তবে আঙুল চালিয়ে সুরে সুরে আওয়াজ তো বের করতে পারি – সেই সুযোগটাই বা আর কোথায় পাই? ওই আশ্চর্য মিষ্টি জাইগ্যান্টিক যন্ত্রটার সামনে রাখা টুলে বসা, সেটাকে ছুঁয়ে দেখা, একটা কর্ড বাজিয়ে প্রাণ ভরে সেই শব্দটাকে উপলব্ধি করা – সেটুকুই বা কম কিসে? এখানে এলে যতক্ষণ ইচ্ছে পিয়ানো বাজানো যেত।

এখানে একবার একটা কান্ড হয়েছিল, যেটা এক্ষুনি বলে না ফেললে কোনও দিন হয়ত আর বলাই হবে না। সাতানব্বই/আটানব্বই সাল কী? তাই হবে বোধহয়। সেটা ছিল দিনের বেলা। সম্ভবতঃ গিটারের স্ট্রিং কিনতে গিয়েছিলাম। দোকানে তখন আরও দুজন খদ্দের। যাঁরা ভারতীয় নন। দুজন দুই দেশের লোক, পরস্পর অচেনা। দুজনের মধ্যে একজন ইংরিজি জানেন, অন্যজন ভাল জানেন না। এঁর ভাঙা ইংরিজিতে সব ‘ট’ গুলো ‘ত’ হয়ে যায়। যিনি ইংরিজি জানেন; টুলে বসে একটা ইলেকট্রিক গিটার তুলে নিয়ে অ্যামপ্লিফায়ার কিউবে তার গুঁজে পিড়িং পিড়িং করছিলেন। স্ট্রিং কেনা হয়ে গেছিল, আমি দোকানে থাকা হারমোনিকাগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। কেনবার সামর্থ না থাকলেও ভালোবাসার জিনিস হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখাতেও মনে হয় একরকমের ভালোলাগা কাজ করে। দুই ভিনদেশীর মধ্যে ‘ট’ কে ‘ত’ বলা মানুষটির আগ্রহ ভায়োলিনে। মাথা ঝুঁকিয়ে, কান কাছে নিয়ে গিয়ে, আঙুল দিয়ে খুঁটে খুঁটে মৃদু আওয়াজ বের করে, তিনি একটা বেহালাকে খুব মন দিয়ে নিরীক্ষণ করছিলেন। ব্র্যাগাঞ্জাদের দোকানটার একটা বিশেষত্ব হল, এখানে দরজা হাট করে খোলা থাকে না। ভাঁজে ভাঁজে খোলা কপাটগুলোর একটা খোলা থাকে, কিন্তু সেটিও ভেজানো অবস্থায় থাকে। ফলে রাস্তার কোলাহল ভেতরে ঢোকে কম। ইংরিজি জানা গিটার হাতে ভদ্রলোক হঠাত্‍ই বলে বসলেন, “হোয়াই ডোন্ট উই প্লে সামথিং…” – কী একটা যেন হল; আমরা তিনজন, যে আমাদের দেশ আলাদা, ভাষা আলাদা, সমাজ আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা, সংগীত আলাদা, কেউ কাউকে চিনি না, প্রথম এবং সম্ভবতঃ শেষবারের মত একে অন্যকে দেখছি – একসাথে বাজাতে শুরু করলাম। প্রথমে তাল দিলেন গিটারওয়ালা। খুব আলগা ভাবে ‘এ মাইনর’ কর্ডে দুটো বার বাজিয়ে ‘সি মেজরে’ ল্যান্ড করলেন ভদ্রলোক। দেখলাম ওয়াল্ত্‍জ-এর ছন্দ। আমার হাতে সে মুহূর্তে ছিল একটা ‘সি’ ক্রোম্যাটিক হারমোনিকা; সেই তালে আমিই সুরটা ধরলাম। কবীর সুমনের সুরে ছোট্ট পায়েলের মিষ্টি করে গাওয়া সেই গানটাই কেন জানি মাথায় এসেছিল তখন;

‘পাশেই কারুর একখানা হাত ধর
কাছেই কাউকে তোমার বন্ধু কর
দূরেও রয়েছে বন্ধু মিষ্টি হেসে
হয়ত কোথাও হয়ত অন্য দেশে…’

প্রথম স্তবকের সুরটা শুনে, দেখলাম হাসি ফুটে উঠল ভায়োলিন হাতে নেওয়া ভদ্রলোকের মুখে। এবারে ধরলেন তিনি। গানটার ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দিতে লাগলেন আশ্চর্য সব কারুকার্য, হারমনাইজেশন। সে যে কী হল কী বলব! একটা ঘোরের মত অবস্থা। কতক্ষণ চলেছিল ব্যাপারটা মনে নেই। গান শেষ হলে আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে গ্রিট করে বেরিয়ে পড়লাম দোকান থেকে। ইতিহাস জানে, আর কোনদিন আমাদের দেখা হবে না। সুমনদার তৈরি সুরের কাঠামোটাকে কেন্দ্রে রেখে যে বিপুল বিচিত্রতা সেদিন হঠাত্‍ সৃষ্টি হয়েছিল তিন অপরিচিতের যন্ত্রে – সেটা কেবল আমার স্মৃতিতেই থেকে যাবে। ও আমি ভুলতে পারব না; কোটি মন্বন্তরেও না।

কলকাতার খুব সামান্য কয়েকটা জায়গা, যেগুলো গা থেকে এখনও সময়ের গন্ধ ঝেড়ে ফেলেনি, আজও একই রকম থেকে গেছে – ব্র্যাগাঞ্জাদের বাজনার দোকানটা তাদের মধ্যে অন্যতম। তবে কতদিন আর থাকবে বলা মুশকিল।

স্যার স্টুয়ার্ট হগের নাম লেখা বাজারের পুরোনো সদর দরজাটার উল্টোদিকে সরু রাস্তা ধরে তত্‍কালীন গ্লোব সিনেমার পূর্ব দিকের গেট পার হয়ে কিছুটা এগোলে ডানদিকে একটা পাঞ্জাবীদের রেস্তোঁরা আছে। সে সময়ে সেটা ছিল আমার নৈমিত্তিক জলযোগের ঠিকানা। ব্যাপারটা এরকম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যে কিছু বলতেও হতো না, গিয়ে একটা টেবিলে বসে পড়লেই আমার জন্যে ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর কফি চলে আসতো। কাউন্টারের শিখ ভদ্রলোকটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই একমুখ কাঁচা পাকা দাড়ির ফাঁক দিয়ে একটু হেসে হাতের ইশারায় বোঝাতেন যে তিনি আমাকে লক্ষ্য করেছেন। হেসে জবাব পাঠাতাম আমি। আমার ভাল মন্দে ওঁর কিছুটি এসে যাবার কথা নয়, দুজনে পরষ্পরের নাম অবধি জিজ্ঞেস করিনি কোনদিন। অথচ কয়েকদিন না গেলে বিল মেটানোর সময় খুব মৃদু স্বরে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করতেন আমার অসুখ বিসুখ করেছিল কিনা ইত্যাদি। এই ‘সিসিডি’র যুগে দ্যাট ক্যালকাটা ইজ নো মোর।

বেশীদিনের কথা নয়। দুহাজার সাল। জুলাই মাসের আধভেজা সন্ধ্যে। ওখান থেকে কফি আর ফ্রেঞ্চ টোস্ট সাঁটিয়ে যথারীতি ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের দিকে পা বাড়িয়েছি। একটু হেঁটে সাদার স্ট্রীটে এসে পড়ে বাঁদিকে ঘুরলেই বাঁ হাতে হ্যান্ডিক্রাফ্ট আর ওরিয়েন্টাল গয়নার একটা একফালি দোকান ছিল। সেটার কাছাকাছি পৌঁছতেই কানে একটা অদ্ভূত সুরেলা আওয়াজ ভেসে এল। আওয়াজটা সত্যিই অদ্ভূত – খানিকটা সানাই আর ট্রাম্পেটের মাঝামাঝি শব্দ। এ শব্দের চরিত্র ভাষায় বর্ণনা করা একটু কঠিন। সানাইয়ের মত সুরে ঢালা নয় একথা ঠিক। কিন্তু সুরে কমতিও তো নেই কোথাও। ‘ব্যাঁ–’ করে একটা গম্ভীর সুরেলা শব্দ, যেটা আবার ঠিক নিটোল নয়, ট্রাম্পেট ধাঁচের; একটু ফাটা ফাটা। বোঝানোর খাতিরে – সানাই যদি শ্যামল মিত্তির হন, ইনি জর্জ বিশ্বাস হতে পারেন, লেনার্ড কোহেন কিছুতেই নন।

এ হেন আওয়াজে কাটা কাটা সুর লাগিয়ে খানিকটা ট্রাম্পেটের ঢঙে কেউ পুরনো হিন্দী ছবির একটা গান বাজাচ্ছেন।

‘ইয়াদ কিয়া দিল নে কাঁহা হো তুম
ঝুমতি বাহার হ্যায় কাঁহা হো তুম
পেয়ার সে পুকার লো জাহাঁ হো তুম’

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর লতা মঙ্গেশকরের ডুয়েট; ‘পতিতা’ ছবির গান। ছেলেবেলায় খুব বাজাতাম; কানটা আপনা থেকেই খাড়া হয়ে গেল। চমত্‍কার সুর বটে গানটার। আর ইনিও, শুধু বাজাচ্ছেনই না, সুরের বিশেষত্ব বুঝে ফাঁকা অংশে ঢোকার মুখের স্ট্যান্ডিং নোটগুলোর ওপরে একটা সুনিয়ন্ত্রিত ভাইব্রাটো করছেন। তার চেয়েও বড় কথা সুরের ফ্রেজ গুলোকে অযথা টেনে লম্বা না করে ঠিক জায়গা বুঝে কাটছেন; যেটা অনেক প্রশিক্ষিত শিল্পীরাও গাইতে-বাজাতে গেলে দেখি কিঞ্চিত্‍ বাড়িয়ে ফেলার লোভ সামলাতে পারেন না।

দাঁড়িয়ে পড়ে এ শব্দের উত্‍স সন্ধানে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। নজরে পড়ল, রাস্তার একপাশে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে মাথায় সাদা টুপি পরা এক বৃদ্ধ, কাপড়ের সাইড ব্যাগে একপাঁজা বাঁশি নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তার থেকেই একটা তুলে নিয়ে বাজাচ্ছেন। এ বাঁশি থেকে বেরচ্ছে ওর’ম শব্দ! এগিয়ে গেলাম তাঁর দিকে।

বাঁশের তৈরি কালো রঙের এই যন্ত্রটাকে ঠিক বাঁশি বলা চলে না; তবে আর কী বলব, তাই বাঁশিই বলছি। আড় বাঁশির মত নয়, এ বাঁশি সোজা ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয়। বাঁশির মত মুখের কাছটায় পাতলা একটা বাঁশেরই টুকরো গোঁজা থাকে, গোটাটা মুখে ঢুকিয়ে ঠোঁট দিয়ে চেপে ফুঁ দিয়ে শব্দ বের করতে হয়। অর্থাত্‍ সানাই বা স্যাক্সোফোন এর মুখ যে ফর্মুলায় তৈরি, এও তাই।  বাঁশের গায়ে ছটা ফুটো দিয়ে টিউনিং করা, নরম্যালি বাঁশের বাঁশিতে যেমন থাকে। সব মিলিয়ে বেশ অভিনব ব্যাপার। এ জিনিস একখানা বাড়িতে না নিয়ে গেলেই নয়। নিলাম একখানা। কিন্তু ফুঁ দিতে গিয়েই চিত্তির! দেখি গাল ফুলছে, কিন্তু বাঁশি কিছু বলছে না। ব্যাপারটা দেখলাম সোজা নয় মোটেই। ভদ্রলোককে ধরলাম; “কী করে শব্দ বের করছেন শিখিয়ে দিন, নইলে বাজাব কী করে?” ভদ্রলোক বাংলা একদম বলতে পারেন না, হিন্দিতে আমাকে শব্দের উত্পত্তির ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু শব্দ আমি করতে পারি না মোটে! ঠোঁট ব্যাথা হয়ে যায়। ভদ্রলোক দেখলেন এ বান্দা ছাড়ছে না, বললেন, “ঘর যা কে কোশিস করতে রহিয়ে গা, বাঁশরী জরুর বোলেগি”। আমার তর সয় না। তক্ষুনি আওয়াজ বের করতে হবে। ভদ্রলোক আমাকে নিরস্ত করতে না পেরে নিজের মুখে বাঁশি তুলে নিয়ে আবার বাজাতে লাগলেন – ‘ও… রাত ঢল চুকি হ্যায় সুবাহ হো গয়ি… ম্যায় তুমহারি ইয়াদ লে কে খো গয়ি’…

তাঁকে তো বাঁশি বেচতে হবে। আমাকে নিয়ে পড়ে থাকলে তাঁর চলবে কেন? পাশে দাঁড়িয়ে আমার ‘কোশিস’ চলতে লাগল। একবার আওয়াজ বেরল! খানিকটা পিছলে যাওয়া শব্দ। ভদ্রলোক অন্তরাটা বাজাতে বাজাতে আড়চোখে আমাকে দেখে নিলেন একবার। আবারও বেরল আওয়াজ। এবার তুলনামূলকভাবে ফার্ম হল ফুঁ টা। ওদিকে অন্তরার চড়া সুরটা শেষ হচ্ছে, এর পরে ফের আগের সুরটা ফিরবে: ‘অব তো মেরি দাসতাঁ হো তুম…’

বিটকেল শব্দের দুটো বাঁশি একসাথে বেজে স্থায়ীর সুরে ফেরাল গানটাকে।

– “আরে, আপ তো গানে-বজানে ওয়ালা আদমি হ্যায়!”

বলার চেষ্টা করলাম, “কিচ্ছু হল না মশাই। আপনার মত ভাইব্রাটো হচ্ছে কই?” একটু যেন বিরক্ত হলেন বৃদ্ধ মানুষটা। পাতলা বাঁশের নমনীয় পাতটাকে নিচের ঠোঁট দিয়ে চেপে গলার কাছে হাওয়ার দলা জমিয়ে রেখে হিসেব করে ঠেলা মেরে মেরে আর নিচের ঠোঁটের চাপের তারতম্যে কিভাবে সুরটাকে কাঁপাতে হয়; করে দেখালেন তিনি। বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ব্যাপারটা মোটেই সহজ ছেলেখেলা নয়। এটা করতে অনেকখানি আয়াস লাগে, অভ্যাস লাগে। এমনি এমনি হবে না।

বুড়ো মানুষ। কেই বা অত পাত্তা দেয়, কেই বা দুটো কথা বলে কাছে এসে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মত গাল ফুলিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দেবার বিফল চেষ্টা করে গেছি বলেই হয়ত, ভদ্রলোক কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন আমার সাথে। বুঝলাম যে কথাগুলো বলার মত লোক পান না তিনি। পরিচয়হীন এই প্রবীণ যন্ত্রশিল্পীর সঙ্গে ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে হঠাত্‍ একদিন যুবক হয়ে ওঠা এই আমিটার দূরত্ব কমতে লাগল ক্রমশঃ।

– “লোকে ভাবে ছেলেখেলা! পঁচিশ-পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বাঁশি কিনে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখে আর ফুঁ ফাঁ দিয়ে হিন্দী গান বাজানোর চেষ্টা করে। কিসসু হবে না!”

– “কী হবার কথা বলছেন? কী হওয়া সম্ভব এতে?”

– “বলছ কী হে ছোকরা? বাজাতে জানতে হয়, মিউজিকটা শেখার জিনিস। তোমার কানে সুর আছে তাই বলছি, শোনো, এটাকে বলে ‘দেশ’। এখন সময় নেই, আর এটা ঠিক জায়গাও নয় এ সব বাজানোর। ছোট্ট করে বাজাচ্ছি। কে শুনবে? কেউ আর এসব শোনে-টোনে না!”

এবার আমার অবাক হবার পালা। ওই যন্ত্রে এরকম বাজনা হয়! বাজনার স্টাইল পাল্টে গেছে বুড়োর। অবিকল সানাই! ওই রকম মীড় – মোচড় দিয়ে বুকের ভেতর ঢুকে পড়তে চাইছে সুরটা। সামান্য একটু আলাপ বাজিয়ে একটা বন্দিশের ছোট্ট একটা হিন্ট দিয়ে সমে পড়ে অ্যাবড্রাপ্টলি থামিয়ে দিলেন বৃদ্ধ – “এটা ‘দেশ’। ‘মালকৌষ’ শুনবে? এখন অবশ্য বাজে না, এটা আরও পরের রাগ।”

ঘোড়ায় যেন জিন দিয়ে এসেছেন, হাতে সময় খুব কম। আর তার মধ্যে যতটা পারা যায় নমুনা দেবেন আমাকে। সে যে কী বাজনা কী বলব! এইভাবে মিডল স্ট্যাম্প উপড়ে নিয়ে বোল্ড আউট করতে খুব কম মানুষ পারেন। অত সংক্ষেপে কী করে ধরছেন একেকটা রাগকে? কী করে বুনে দিচ্ছেন তাদের চেহারা? সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে চিনিয়ে? কতটা ভাল ছবি আঁকতে জানলে এত সামান্য স্ট্রোকে এমন পোর্ট্রেট আঁকা যায়?

অস্থিরমতি বালকের মত রাগ থেকে রাগে ছুটে ছুটে যাচ্ছেন বৃদ্ধ। আজই যেন পৃথিবীর শেষ দিন। তাঁর সমস্ত ‘মিয়াঁ কী মলহার’, ‘দরবারী কানাড়া’, ‘শুদ্ধ কল্যাণ’, ‘মিশ্র পিলু’র ভাণ্ডার যেন তক্ষুনি তক্ষুনি উপুড় করে দিতে হবে।

– “নাম কী আপনার?”

– “জী একরাম হোসেন।”

– “আপনার এই বাঁশি তো আগে কোথাও দেখিনি, আপনি কী নিজেই বানান এগুলো?”

– “জী হাঁ। শুরু তো হামারে হাথ সে হি হুয়া থা – অভি অউর দো চার বন্দে নে ভি বনাতা হ্যায়, বেচতা হ্যায় ইয়ে। লেকিন উও সব দো দিন কা ছোকরা হ্যায়। ইয়ে উনকা ধন্দা হ্যায়। ‘মিউজিক’ আতা নহি হ্যায় উন লোগো কো। শালা দো চার হিন্দী গানা-ওয়ানা বাজা লেতা হ্যায়, লেকিন… ক্লাসিক্যাল মিউজিক কা কুছ ভি নহি আতা – আরে মিউজিক তো শিখনেওয়ালি চিজ হোতি হ্যায় – অ্যায়সে বিসমিল্লা জী ওয়ালা ফুঁক আপকো কাহাঁ মিলেগা?”

চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। হ্যাঁ, এতক্ষণ এঁর বাজনা শুনে, বাজনার স্টাইল শুনে ওই ভদ্রলোকের কথাই মনে হচ্ছিল বই কী! কিন্তু কোথায় সানাই আর কোথায় এই বাঁশি। আলাদা শব্দ, আলাদা যন্ত্র – কিন্তু এই ভদ্রলোকের মেজাজে, অ্যাপ্রোচে সেই সম্বন্ধ আছে বই কী!

– “আপনি শিখেছেন কার কাছে?”

কানে হাত চলে গেল বৃদ্ধের – “উস্তাদজী থে না হমারা!”

বোঝো!

– “এক চিজ আউর সুন লিজিয়ে। ইয়ে হ্যায় রাগ দুর্গা”…

বলেই বাজাতে শুরু করলেন ভদ্রলোক। অনবদ্য! এই রকম সংক্ষেপে কী করে বাজাচ্ছেন ইনি? আমি কাউকে করতে শুনিনি এ জিনিস। ছোট্ট আলাপ তার পরে মধ্য লয়ে ঠিক চার লাইনের বন্দিশ। তেহাই-টেহাইয়ের করবার নেই, অ্যাবড্রাপ্টলি স্টপ। কী নির্মেদ ভাবনা রে বাবা! কোনও রকমের বাহুল্য ছাড়াই যেটা এস্টাব্লিশ করতে চাইছেন সেটা কিন্তু করে ফেলছেন!

– “আপনি এখানেই থাকেন? এখানে এলেই আপনার সাথে দেখা করা যাবে?”

– “আমাকে না পেলে খুঁজে দেখবেন আশে পাশে। ‘নবাব সাহাব’ কে লিয়ে পুছিয়ে গা ইধার –”

– “‘নবাব সাহেব’ মানে? আপনার নাম একরাম হোসেন না?”

– “হাঁ, উও তো মেরা নাম হ্যায়, লেকিন ইধার সব লোগ মুঝে ‘নবাব সাহাব’কা নাম সে হি পহেচানতা হ্যায়।”

বৃষ্টি আসছিল। ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একছুটে সাদার স্ট্রীট ধরে ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের সামনে দিয়ে পার্ক স্ট্রীট মেট্রো। সামান্য ভিজে গেছিলাম। তখনও বোধহয় স্মার্ট কার্ড বেরোয়নি, আটচল্লিশ রাইডের টিকিট। পার্ক স্ট্রীট থেকে উঠলে দমদম পর্যন্ত দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা যায়। দরজা খোলা – বন্ধ – লোক ওঠানামা – সরে দাঁড়ানোর ঝক্কিটা পোহাতে হয়না। তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে আর টানেলের টিউবলাইট গুনতে গুনতে বাড়ি ফিরেছিলাম সেদিন।

এই ঘটনার দু এক দিনের মধ্যেই আমার খাতায় তাঁর নামে একটা ব্যালাড লেখার চেষ্টা স্থান পেয়েছিল। সেই পৃষ্ঠা থেকে তারিখ সমেত সমস্তটুকু এখানে তুলে দিলাম –

*      *      *

একরাম হোসেনের হাতে
————————————————-

পরিচিত সান্ধ্য শহর
তেমন নির্জনতা নেই
তবু তার খোঁজে হেঁটে যাই
আজন্ম দেখা শহরেই

সাহেব পাড়ার অলিগলি
প্রায়দিনই হাঁটি ওই পথে
একঘেয়েমির থেকে ছুটি
চেয়েও পড়েছি বাঁধা গতে

তোমার কি ছিল বাঁধা গত্‍
এই শহরেই ছিল ভিটে
এক পাঁজা বাঁশি হাতে নিয়ে
দেখা হল ফ্রী-স্কুল স্ট্রীটে

যদিও প্রথম দেখা হল
তবু কি তোমার কথা ভেবে
ওপথে হেঁটেছি প্রায়দিনই
আমাকে তোমার সাথে নেবে?

সানাইয়ের সুরে পরিচিতি
আলাপের থেকে বুঝি জোড়ে
যেতে জানে এখনো মানুষে
আমাদের এমন শহরে

একলা দাঁড়িয়ে একধারে
বাঁশি হাতে বৃদ্ধ আগুন
আমার মতন কত বুকে
জ্বেলে দিলে সানাইয়ের ধুন

হাঁটতে হাঁটতে আনমনে
দাঁড়িয়েছি তোমাকেই দেখে
অমন কান্না ঢালা সুরে
বাজাচ্ছ তুমি কবে থেকে

কতদিন থেকে সুরগুলো
অমন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে
যেমন কান্না শুনি আজও
তোমার বৃদ্ধ দুটো ঠোঁটে

এখনো ঝিলিক মারে চোখে
সুরগুলো বিদ্যুত্‍ হয়ে
বৃষ্টিতে ভিজেছি আমিও
এই বুকে সংগীত বয়ে

এই বুকে রাখা যন্ত্রণা
কেঁদে ওঠে বৃদ্ধের সাথে
ভাবি একবার বেজে উঠি
একরাম হোসেনের হাতে…

————————————————-
২৯ জুলাই ২০০০, রোববার। দমদম ক্যান্টনমেন্ট।
————————————————-

*      *      *

এর দিন কয়েক পরে, অমোঘ ভাবে আবারও একটা কলকাত্তাইয়া সন্ধে, আমাকে ডাক দিল। আর আমিও নিরুপায় সম্মোহিত যুবক, ঘুর ঘুর করতে লাগলাম ওখানে; ওই রাস্তায়। ফের দেখা হল তাঁর সাথে। আমি আগ্রহ নিয়ে এসেছি দেখে বেজায় খুশি তিনি। কেউ তো আসেনা বৃদ্ধের কাছে।

কত না তাঁর কথা, কত না গল্প। অনেকগুলো বছর কাটল; খুব স্পষ্ট মনে পড়ছে না আর, সম্ভবতঃ তিনি লখনউ থেকে চলে এসেছিলেন এখানে। সানাই বাজাতেন ছেলেবেলায়। রোজগারের তাগিদ যৌবনে ট্রাম্পেট ধরায়। এই কলকেতারই কোনও একটা বারে চাকরিও হয়। কোনওক্রমে চলে যাচ্ছিল তাঁর। একদিকে বয়েস বেড়েছে, শরীর ভেঙেছে – অন্যদিকে মদ্যপায়ীর সংখ্যা বাড়লে কী হবে, তাঁদের সাংগীতিক রুচির ঘটে গেছে আমূল পরিবর্তন। ট্রাম্পেটও আর চলে না। বাজারে ইলেক্ট্রনিক বাজনার রমরমা। প্রয়োজন ফুরিয়েছে তাঁর।

“ইয়ে শুন লিজিয়ে – ভয়রোঁ।” আবার খানিক গল্প। তারপর “ইয়ে হ্যায় রাগ খামাজ”। খানিক পরে আবার “রাগ দুর্গা”। এই ভোর তো এই রাত দুপুর – নাই বা থাকলো সময়ের ঠিকঠাক – একজনকে পাওয়া গেছে; শোনাতে তো হবে। যে শিল্পীর কোনও শ্রোতা নেই তাঁর আবার ভোর আর রাত! যেই না বলি – “দুর্গা তো শুনলাম, একটু আগে যে বাজালেন” –

– “মুঝে আচ্ছা লাগতা হ্যায়।” এক মুখ হাসি। বুঝলাম দুর্গা তাঁকে পাকাপাকি ভাবে পেড়ে ফেলেছে।

একবার নাকি সাদার স্ট্রীটে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের মনে বাঁশিতে দুর্গা বাজাচ্ছিলেন, আর এক ভদ্রলোক নাকি হঠাত্‍ তাঁর দিকে এগিয়ে এসে জিগগেস করেছিলেন – “ইয়ে ‘বিসমিল্লাজি ওয়ালা ফুঁক’ আপকো কাহাঁ সে মিলা?” জানা যায় প্রশ্নকর্তা ভদ্রলোক নাকি স্বয়ং খান সাহেবের পুত্র। আজ অবধি এটাই একরাম হোসেনের জীবনে সেরা প্রাপ্তি।

কথার ফাঁকে ফাঁকে অক্লান্ত এবং সংক্ষিপ্ত ভাবে বাজিয়ে চলেছেন তিনি। সংক্ষিপ্ততাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। চার লাইনের গত্‍। আর তাতেই তুলে ধরেন রাগের চেহারা। সানাইয়ের বিরল বিভঙ্গে। তাও আবার ওরকম একটা বিদঘুটে ইন্সট্রুমেন্টে! কজন পারেন এমন ভাবে ভাবতে?

এত শুনিয়েও কিন্তু তাঁর সোয়াস্তি নেই মনে। বললেন – “রাস্তার আওয়াজে কি ভাল করে শোনা যায়? নিরিবিলিতে বাজলে মন দিয়ে শুনতে পারতেন”।

– “আপনার বাড়ি যেতে পারি। আপনি এখানে থাকেন কোথায়”?

– “এখানে তো থাকি না। আমি থাকি ‘পারবাত সিনিমা হাওল’ এর ‘বগল ওয়ালা’ গলিতে।”

– “কী সিনেমা?” বুঝতে না পেরে জিগগেস করি।

– “‘পারবাত সিনিমা’। ‘মাহাজাতি সাদান’ কে ‘আপজিট’ পাস। কিসিসে ভি পুছিয়েগা – বাতা দেগা। উসকা বগল ওয়ালা গল্লি মে ঘুসিয়ে গা। ডহীনা সাইড, পাঁচওয়া ঘর।”

– “সানডে কো মেরা ছুট্টি হ্যায়। সুবহে নও-দশ বাজে চলা আউঁ?”

– “জী জরুর।”

চললাম বাড়ি। মাথায় ওঁর সিম্পল অ্যাড্রেস। ‘ডহীনা সাইড, পাঁচওয়া ঘর’। এখন ‘পর্বত সিনেমা’ না কী – সেটা খুঁজে পেলে হয়… তার পরে ‘বগল’ ওয়ালা গলি।

শনিবার রাত্তিরে ছোটকাকার সাথে দেখা। জিগগেস করলাম – “মহাজাতি সদনের উল্টোদিকে কী সিনেমা হল আছে গো?”

ছোটকাকা একটু ভাবলেন, শূন্যে হাত দিয়ে কয়েকটা আঁক কষলেন, তারপর বললেন – “প্রভাত?”

গুডনেস গ্রেসিয়াস!

– “তবে ঠিক অপজিটে নয়।”

– “উঁ?”

– “ঠিক উল্টো দিকে নয়, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে দক্ষিণ দিকে আর একটু এগিয়ে যেতে হবে। ডায়াগনালি অপোজিট বলতে পারিস। কী হবে ওখানে?”

– “কিছু না, ভাবছি একটা সিনেমা দেখে আসব।”

– “ধুস!” হেসে ফেললেন কাকা।

রোববারের সকাল, তাই নো মেট্রো। কাজেই, মিনিবাসই ভরসা। সাড়ে নটা নাগাদ মহাজাতি সদন স্টপে বাস থেকে নেমে ছোটকাকার কথামত হাঁটতে হাঁটতে ধরমতলার দিকে আরও এগিয়ে গেলাম কিছুটা। উল্টো দিকে দেখি বেশ পুরোনো একটা সিনেমা হল। পর্বত-টরবত নয়, ছোটকাকার কথা মত ‘প্রভাত’ই বটে। পেরলাম রাস্তা। যদ্দুর মনে পড়ছে, সেই অপরিসর গলিটা সিনেমা হলের বাঁদিকই ছিল সম্ভবত; আর একরাম সাহেবের ঘরের দরজাটা ছিল দক্ষিণ দিকে মুখ করা। তাহলে এই সেই ‘বগল’ ওয়ালা গলি। গলির ডানদিকে ছোট ছোট সার দেওয়া ঘর। বাইরে থেকে যে খুব একটা পরিষ্কার পরিবেশ বলে মনে হচ্ছে না, সেটা বলাই বাহুল্য। কলকাতার ছেলে; এধরণের বস্তি যে দেখিনি তা নয়, কাজেই খুব একটা অচেনা লাগছিল না পরিবেশটা। গলিতে ঢুকে পাঁচ নম্বর দরজার কাছে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ। চিনি শুনি না, খামোখা খট খট করতে হবে ভেবে কিন্তু কিন্তু করছিলাম একটু। এমন সময়, রাস্তায় দেখলাম বছর দশ-বারোর দুটো বাচ্চা ছেলে একটা সাইকেলের চাকার রিং রাস্তায় গড়িয়ে দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে সেটার পেছনে ছুটতে ছুটতে এদিকে আসছে।

– “এই শোন – ” আমার ডাক শুনে এমন থতমত খেয়ে গেল ছেলে দুটো, যে সাইকেলের রিঙে লাঠি দিয়ে পরের টোকাটা দিতে ভুলে গেল; আর সেটা শক্তি চাটুজ্যের মধ্যরাতে ফুটপাথ বদল করা পায়ের মত দুবার এদিক ওদিক টলতে টলতে শব্দ করে রাস্তায় পড়ে গেল।

– “এখানে একরাম হোসেন কোথায় থাকেন রে? কোন বাড়িটা?”

ছেলেদুটো রিং ভুলে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মুখে কোনও কথা নেই তাদের। এদিকে রাস্তায় সাইকেলের রিং পড়ার ঠং ঠঙাত্‍ শব্দ শুনেই হয়ত, ঘেঁষাঘেঁষি দুটো বাড়ির মাঝখানের কোনও একটা অলীক ফাঁক দিয়ে, ফিকে হয়ে যাওয়া লাল গেঞ্জি আর হাফ গোটানো সবুজ লুঙ্গি পরা এক যুবক নিম ডাল নিয়ে দাঁতন করতে করতে দেখি বেরিয়ে এসেছেন। অবিন্যস্ত মুখাবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে বেলা প্রায় পৌনে দশটা হয়ে গেলেও খুব বেশিক্ষণ আগে ইনি বিছনা ছাড়েননি।

– “কৌন?” – নিম ডালটাকে মুখে রেখেই জিগগেস করলেন তিনি।

– “জী জনাব একরাম হোসেন”। যথা সম্ভব সম্মান দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম।

– “ইয়াহাঁ তো… উস নাম পে…” বুঝতে পারছিলাম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসতে চলেছে। যুবকটির কথার ফাঁকে কথা গুঁজে দিলাম; একরকম মরিয়া হয়েই – “জী বাঁশরী বাজাতে হ্যায় উহ্ননে।” মুখের সামনে দুটো হাত নিয়ে এসে ইশারা সমেত বললাম “শেহনাই কে তারাহ -”

কথা থেমে গেল যুবকটির। কয়েকটা কথাহীন মুহূর্তের পর নিমডাল বেরিয়ে এল যুবকটির মুখ থেকে। একটা থুথু ফেলে জিগগেস করলেন – “নবাব সাহাব?”

আমি সময় ব্যয় না করে বলে উঠলাম “হাঁ হাঁ – ইয়ে নাম ভি বোলে থে মুঝে -”

– “ইসি ঘর মে রহতা হ্যায় উয়ো” – সেই পাঁচ নম্বর বন্ধ দরজার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন যুবকটি। তারপর নিজেই খটখটালেন সে দরজায় – “জরা দেখিয়ে তো – কোয়ি আপসে মিলনে আয়ে হ্যায় -”

– “কৌন?” ভেতর থেকে সাড়া এল। তার পর খুলে গেল দরজা।

একরাম হোসেন ওরফে নবাব সাহেব প্রথমে ফিকে লাল গেঞ্জি পরা ছেলেটিকে দেখে তার পরেই আমার দিকে চোখ ফেরালেন। তাঁর মুখে ফুটে উঠল হাসির রেখা – “আরে আইয়ে আইয়ে – ম্যায় তো আপ হি কে ইন্তেজার মে থা…” রাস্তায় দুটো বাচ্চা আর ওই লাল গেঞ্জিকে কৌতূহলে রেখে আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছিলেন: ‘পুকুর, মরাই, সবজি-বাগান, জংলা ডুরে শাড়ি / তার মানেই তো বাড়ি।’ আর যে বাড়ি আমি দেখলাম, সে ঘর, সে দুয়োর স্বপ্নে দেখা যায় না। আট ফুট বাই সাড়ে ছ’ ফুটের বেশি হবে না ঘর টা। ঘরে আসবাবপত্র বলতে ডায়াগনালি টাঙানো একটা দড়ি। তার একপাশে একটা পাঞ্জাবী, আর একটা নীল লুঙ্গি ভাঁজ করে মেলা। অর্থাত্‍ শুকোনোটা উদ্দেশ্য নয়, সে দড়ি আসলে আলনার সাবস্টিটিউট। এ ঘরের দেওয়ালে দড়ির দুটো মাথা ছাড়াও আরও দুটো পেরেক পোঁতা। তার একটাতে ঝোলানো একটা ছোট আয়না, যার পেছন দিয়ে আবার একটা সাইড ব্যাগ ঝোলানো। আর দরজার মাথায়, অন্য পেরেকটাতে ঝোলানো এলুমিনিয়ামের তৈরি একটা সবুজ চাকতি। যার গায়ে মক্কার সেই বিখ্যাত ছবিটা খোদাই করা। খোদাই জানেন সে ছবিকে ঘিরে থাকা আরব্য ক্যালিগ্রাফীর হরফ গুলো আসলে কী লিখে রেখেছে। দরজার সামনে বরাবর সেরকমই আরেকটা সাইড ব্যাগ দেওয়াল ঘেঁষে মেঝেতে রাখা আছে। এ ব্যাগ আমার চেনা। এর ভেতরে বাঁশির পাঁজা। সিমেন্ট ল্যাপা মেঝেতে ধবধবে সাদা একটা বেডকভার বিছিয়ে রাখা।

– “আইয়ে জী, বইঠিয়ে ইয়াঁহা।” সাদা চাদরে বসতে আপ্যায়ণ করলেন তিনি।

– “জী হাঁ।” জড়সড় আমি বাবু হয়ে বসি।

– “থোড়াসা তকলিফ হোগা ইস গরীবখানে মে –”

– “জী কোয়ি বাত নহি; আপ বিলকুল ফিক্র মত কিজিয়ে। আপ অকেলে হি রহেতে হ্যায়?”

– “অউর তো কোয়ি হ্যায় নহি।” হঠাত্‍ যেন কিছু মনে পড়ল তাঁর। তারে ঝোলানো পাঞ্জাবীটার পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা আধ ময়লা নোট বের করে হাতের তালুতে মুড়িয়ে রাখলেন তিনি। তারপর দরজা দিয়ে মুখ বার করে ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে চিত্কার করলেন – “শাহনওয়াজ! – আরে এ শাহনওয়াজ!”

সেই ফিকে লাল গেঞ্জি দরজার সামনেটায় এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধ তার হাতে পাঁচটা টাকা তুলে দিয়ে নির্দেশ দিলেন মেন রোডের দোকান থেকে মেঠাই আনতে। তাঁর ঘরে মেহমান এসেছে।

প্রচণ্ড লজ্জায় আমার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। ছি ছি! মিষ্টি তো আমার নিয়ে আসা উচিত ছিল। প্রথমবার কারুর বাড়িতে আসছি। মাথাতেই আসেনি বিলকুল। কোনও দিন এসব বোধবুদ্ধি আমার হবে না। যাচ্ছেতাই অসামাজিক টাইপের মানুষ আমি। সলজ্জ ভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করলাম – “ইস কা কেয়া জরুরত হ্যায়, আপ আইয়ে না, ইয়াহাঁ বইঠিয়ে -”

– “নহী জী। আপ তো মেহেমাঁ হ্যায়। পহেলী বার আয়ে হ্যায় – ” কে শোনে কার কথা – মেহেমানকে এভাবে লজ্জায় ফেলে অপ্রস্তুত করাটাও যে কাজের কাজ নয়, সেটা কী করে বোঝাই বৃদ্ধকে!

শালপাতার বাটিতে মেঠাই এল। আমি বললাম – “হম আকেলে নেহি খায়েঙ্গে – আপ কো ভি লেনা পড়েগা -”

হোসেন সাহেব দ্বিরুক্তি করলেন না। দুজনে মিলে ওই বাটির মেঠাই খেলাম। তারপর পানি। অতিথি সত্‍কার সম্পূর্ণ হয়েছে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন তিনি।

তারপরে শুরু হয়েছিল আমাদের গল্প। আর তাঁর বাজনা। অমন আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে কত কত রাগ যে সেদিন বাজালেন হোসেন সাহেব – তার ইয়ত্তা নেই। স্থান কালের পরিবর্তন তাঁর সেই সংক্ষিপ্ত বাদন শৈলীর পরিবর্তন ঘটায়নি দেখলাম।

– “তো জনাব, আপ শেহনাই কেঁউ নহি বজাতে হ্যায়?” প্রশ্ন করেই মনে হল এ প্রশ্নের মেরিট নেই।

– “নহি, উও তো ম্যায় বচপন মে ছোড় দিয়া। উস্তাদ জী ভি গুজর গয়ে…” আনমনে যেন স্মৃতির পাতা ওল্টালেন বৃদ্ধ। “লেকিন অভি ভি দো-চার শাদি মে বুলা লেতা হ্যায় – শেহনাই বজানে কে লিয়ে –  লেকিন সালা পইসা অইসা দেতা হ্যায়; ভিখ মাঙ্গা কি তরহ – বজানে কে দিল হি নহি করতা। ছোড়িয়ে, ফির… আউর এক দফা দুর্গা হো যায়ে?”

লক্ষ্য করছিলাম, দুর্গা রাগটা যেন ভদ্রলোকের আশ্রয়। ক্রমশ মনে হচ্ছিল, যখনই নিজের বাস্তবে থিতু হতে চান, ভদ্রলোক দুর্গা বাজিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেন। আরও লক্ষ্য করছিলাম, এই এতবার যে বাজাচ্ছেন, কোনওবার কিন্তু বন্দিশ রিপিট করছেন না। রাগের রূপটুকু  দেখিয়ে সুরগুলো প্রতিবারই নতুন চেহারা নিচ্ছে। আর এই ছোট্ট চেহারাটুকু এঁকে দেওয়াতেই যেন তাঁর শান্তি।

তাঁর বাসা থেকে কখন ফিরেছিলাম মনে নেই আর। এটা মনে আছে, যে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, যে তিনি শেখান না কেন কাউকে।

– “শিখনে কে লায়েক অউর কোয়ি হ্যায় নহি। কেয়া সমঝা?” পাল্টা প্রশ্ন – “শিখনে ওয়ালা দিল কুছ অউর হোতা হ্যায়।” হেসে ফেলেছিলেন বৃদ্ধ – “অব তো সব লোগো কো সবকুছ মালুম হ্যায়। শিখনে কে লিয়ে অউর বচা ভি কেয়া?”

– “ফির ভি – কিসিনে পুছা থা কভি? শিখানে কে লিয়ে?”

– “আরে কৌন শিখেগা? পেহেলা সিটিং মে পন্দ্রা হাজার রুপিয়া নজরনা চাহিয়ে। কেশ। কেয়া সমঝা?”

বুঝলাম যে নগদ পনেরো হাজার গুরুদক্ষিণা নিয়ে তবে ইনি শিষ্য কে নাড়া বাঁধবেন। তারপরে তালিমের প্রশ্ন। আর সেরকম দেনেওয়ালা কেউ কি আর রাস্তার বাঁশিওয়ালার কাছে আসে? কাজেই শেখানোর প্রশ্নই ওঠে না। না শেখান, সেও ভি আচ্ছা, কিন্তু পন্দ্রা হাজার ‘কেশ’ যে তাঁর চাইই – যেটা নিয়ম, সেটা নিয়ম। প্রসেস কে তো আর ফাঁকি দেওয়া যায় না! এই না হলে নবাব সাহেব!

নবাব সাহেবের নবাবী মেজাজের পরিচয় আমি পরেও পেয়েছি।

পৃথিবীর কোনও ভাল জিনিস একলা উপভোগ করা যায় না। এমন অভিনব সংগীত আমি আর তো কোথাও শুনিনি, তাই একলা একলা শুনে আর মন ভরছিল না। বিশেষত ওই ফুঁ – ওই প্রিসিশন – ওই শব্দ বিভঙ্গ – অনবদ্য!

আমার পার্টনার ইন ক্রাইম – অভ্রকে এই ভদ্রলোকের গল্প করতাম খুব। সে গল্প শুনে শুনে তার মনেও এঁকে শোনার ইচ্ছে ক্রমশ ঘনিয়ে এসেছিল। একদিন, অভ্র আর তার স্ত্রী মিঠু কে সঙ্গে করে তিন বন্ধুতে চললাম একরাম হোসেনের সান্ধ্য ঠিকানায়।

অভ্রর মনে আছে নিশ্চই; থাকবে সেটাই স্বাভাবিক, কেননা সেও মনে প্রাণে গানবাজনার মানুষ। রাগ দুর্গা শুনে আমার মতই আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল অভ্র। সে আবেশ ছড়িয়ে পড়েছিল সুরের পর সুরে – তারপর গল্পে।- “চা খাওয়া যাক – চলুন।” প্রস্তাবটা পেড়েছিল অভ্র। এক কথায় রাজি হয়েছিলেন একরাম হোসেন।

গ্লোব সিনেমার গলি যেখানটা সাদার স্ট্রীটে মিশেছে, তার পূর্বদিকের ফুটপাথে ছিল একটা চায়ের দোকান। সেখান থেকে চা নিয়ে গল্প করতে করতে চা খেয়ে দাম দিতে যাবার সময় বাঁধলো বিপত্তি। চায়ের দাম দিতে দেবেন না হোসেন সাহেব। “আপনারা আমার বাজনা শুনতে এসেছেন। আমার সাথে আলাপ করতে এসেছেন – আপনারা আমার মেহমান। আমি কী করে চা খেয়ে আপনাদের পয়সা দিতে দিতে পারি? আমি গরীব হতে পারি, কিন্তু অভদ্রতা আমার রক্তে নেই – বিশ্বাস করুন।”

সালাম নবাব সাহাব। আমরা সেদিন অসম্মান করতে পারিনি ওই প্রৌঢ় শিল্পী কে। তাঁর শিক্ষা কে। সৌজন্যবোধ কে।

লখনৌ থেকে কলকাতায় চলে আসা এই নবাবের কাছে আমার আনাগোনা তখনও চলছে। অভ্র একাই নয়, হয়ত আরও কাউকে কাউকে নিয়ে গেছিলাম আমি, তাঁর বাজনা শোনাতে। তখনও বোধহয় পার্কস্ট্রীটে বইমেলা হত। কোনও এক বইমেলা ফেরত্‍ সন্ধ্যেবেলায় মনে হয় যদ্দুর মনে পড়ে ছুটিকে নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর বাজনা শোনাতে। ছুটি উত্সাহ চেপে রাখতে পারেননি। নবাবের সুরে উত্সাহতাড়িত ছুটির কাছ থেকে এর অব্যবহিত পরেই আমি উপহার পেয়েছিলাম একখানি সানাই, সঙ্গে বাজাতে শেখার জন্যে প্রচুর উত্সাহ।

উপহারটা খুব সুপাত্রের হাতে পড়েছিল সেকথা বলতে পারি না। কারণ, এই ঘটনার পর বেশ অনেক দিন যাবত্‍ প্রতিবেশীর বিরাগভাজন হয়ে অবশেষে – ‘সানাইএর ক্যাসেট (তখনও আমার কাছে সিডি এত সহজলভ্য ছিল না) শোনা’তেই যে আমার আত্মারাম মুক্তি পাবেন সেই সারসত্য অনুধাবন করে ফেলেছি। এবং ধরাধামের তাবত্‍ ধূলিকণাকে সানাইটার গায়ে জমিয়ে বসবার অনুমতি দিয়ে দিয়েছি।

বেশি দিনের ব্যবধান নয়; অথচ কী করে জানিনা সময়টা পাল্টে গেল। মাথায় রূপোলী চুলের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়াটাও আশ্চর্যরকম ভাবে বদলে গেল।

খবরের কাগজে খবরের চরিত্র বদল হল। আশপাশটা এমন ভাবে পাল্টে গেল, বলে বোঝানো মারাত্মক কষ্টকর। এমনিতেই নিজের মনে থাকতাম। কিন্তু কলকাতার এই বদলটা আমাকে একরকম ছিটকে দিল। স্বার্থপরতা, কদর্যতা, ঔদ্ধত্য, দাদাগিরি, রুচিহীনতা, বানিয়াপনা নজরে আসতে লাগলো সমস্ত রকম স্তরে। রাজনীতি করিনি কোনদিন, কিন্তু সব দেখে শুনে ব্যক্তিগত স্তরেও চুপ করে থাকা যাচ্ছিল না আর। ক্রমশ মনে হচ্ছিল আমার দেশটা জাষ্ট বিককিরি হয়ে যাচ্ছে। আমি কোথায় যাব? কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?

আত্মিক সংকট তীব্রতর হল। নিজের মধ্যে কেমন গুটিয়ে গেলাম। ও পথে যাতায়াত কমতে লাগলো। নবাবের সাথে দেখা হওয়া কমতে কমতে দুহাজার পাঁচ সালের এরকমই এক অক্টোবরের শেষ দিকে একদিন আবিষ্কার করলাম সন্ধ্যেবেলা ওখানে গেলে আর নবাবের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।

ইট ওয়াজ আ গ্রেট লস ফর মী। পাগলের মত খুঁজতে লাগলাম নবাবকে। আসলে আমার সংগীতকে, কলকাতাটাকে, ছেলেবেলাটাকে, দেশটাকে, আমার চেনা মানুষগুলোকে। চলে গেলাম প্রভাত সিনেমার ‘বগল ওয়ালা’ গলিতে। সেখানে সব নতুন লোক। কেউ বলতেই পারলে না তার কথা।

এর দু এক দিন পরের ঘটনা। একদিন আপিস ফেরত্‍ আবার ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে হাঁটছি। চুপ করে। আসলে কোথাও যাবার ছিল না। কিছু করার ছিল না। এমনি হাঁটছিলাম। হঠাত্‍ কানে এল একটা চেনা আওয়াজ।

খানিকটা সানাই আর ট্রাম্পেটের মাঝামাঝি শব্দ। এ শব্দের চরিত্র ভাষায় বর্ণনা করা একটু কঠিন। সানাইয়ের মত সুরে ঢালা নয় একথা ঠিক। কিন্তু সুরে কমতিও তো নেই কোথাও। ‘ব্যাঁ–’ করে একটা গম্ভীর সুরেলা শব্দ, যেটা আবার ঠিক নিটোল নয়, ট্রাম্পেট ধাঁচের; একটু ফাটা ফাটা। বোঝানোর খাতিরে – সানাই যদি শ্যামল মিত্তির হন, ইনি জর্জ বিশ্বাস হতে পারেন, লেনার্ড কোহেন কিছুতেই নন…

এ পর্যন্ত একদম ঠিকঠাক ছিল, এক্কেবারে চিত্রনাট্য মাফিক। কিন্তু দেখা গেল যিনি এ শব্দের উত্পত্তির কারণ, তাঁর কোনও সুর জ্ঞান নেই। জাস্ট আনতাবড়ি ফুঁ দিয়ে যাচ্ছেন।

দৌড়ে গেলাম। দেখি এক যুবক। হাতে নবাবের তৈরি সেই বাঁশির মতই দেখতে বাঁশি। আমি দৌড়ে যাওয়াতে আমাকে গছানোর চেষ্টা করছিল সে। নবাবের চেহারার বর্ণনা দিয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম, এরকম কাউকে সে চেনে কী না।

– “উও বুডঢা? কৌন জানে, সায়াদ উও মর গয়া হোগা, নেহী তো ফির ওয়াপস আপনা গাঁও চলা গয়া – আপ এক বাঁশরী লে লিজিয়ে না!”

সেদিন সেই শরত্‍ শেষের রাত্তিরে আবার অনেকদিন পরে আমার লেখার খাতা বেরিয়েছিল। আর তাতে আবার উঠে এসেছিল নবাব সাহেবের নাম। তারিখ সমেত এটাও তুলে দিলাম।

*      *      *

ভালই করেছ গিয়ে
————————————————-

যাও।
ভালই করেছ গিয়ে
এ শহর তোমাকে ভাত দেবেনা আর
শরত্‍ শেষ নবাব –
যাও।

#  #  #

কোথায় যেতে পারো তুমি? কত দূরে?
ওদিকেও যে
পাঁজরের আশেপাশে প্রহরা –
সালিমের লোক কেড়ে নেবে ধান-জমি।

একলা কৃষক আল ধরে হেঁটে যান –
যেদিকে সন্ধেতারা ফোটে।

উচ্ছিষ্টের ভাগ নিতে জড়ো হয় হায়নার দল
শকুনও নজর রাখে
খাওয়া হলে এক ফাঁকে
ছিঁড়ে নেবে; যেটুকুন জোটে –

এবারের ভোটে…

#  #  #

তুমি নেই, তাই দেখতে পাওনি নবাব
শহরের মোড়ে মোড়ে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড,
‘স্বাগত হায়না’ ধ্বনি, কাডারের ধ্বজা –
আমাদের মজা।

আমরা যারা বিরিয়ানি খাই –
তুমি খেলে কি না খেলে কী আসে যায় বলো?
এ শহর তোমাকে ভাতও দেবেনা আর।

শরত্‍ শেষ নবাব, যাও।
ভালই করেছ গিয়ে…

#  #  #

কলকাতা আজ ফুর্তি চেনে
মানুষ মানেই কিনতে পারার দল
বেচারামও ওত্‍ পেতে থাকে…
সে সব তোমার জন্যে নয় নবাব –

যাও, ভালই করেছ গিয়ে।

#  #  #

শরত্‍ শেষ –
শিউলি ফোটেনা আর
থালায় শিউলি-সাদা ভাতও জোটেনা

কিন্তু খিদে তো জোটে নবাব!

যাও, ভালই করেছ গিয়ে –
কলকাতা তোমাকে ভাতও দেবেনা আর।

#  #  #

ভালই করেছ গিয়ে।

শরত্‍ বিগতপ্রায়।
হেমন্ত উঁকি দিচ্ছে অসময়ের মেঘের আড়ালে।
লুকিয়ে লুকিয়ে রাতভোর
হিম ফেলে ঘাসে ঘাসে।

তার আশেপাশে –
পড়ে থাকে কয়েকটা
ইন্সট্রুমেন্ট ইতঃস্তত…
চ্যাপ্টা বাঁশের বাঁশি, সানাই, ট্রাম্পেট –

ভরবে না পেট!
যাও!

ভালই করেছ গিয়ে।
কলকাতা তোমাকে ভাতও দেবেনা আর –

দেবে শুধু গন্ধ –
যে গন্ধে দেখ ভেসে যাচ্ছে দুর্গা রাগের রূপ –

শরত্‍ শেষ নবাব।

————————————————-
২৭ অক্টোবর ২০০৫, বৃহষ্পতিবার। দমদম ক্যান্টনমেন্ট
————————————————-

*      *      *

এর পরের কথা আর কী বলব – পর পর কয়েকটা বছর কত দ্রুত কত কী যে ঘটে যাচ্ছিল। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম। গা শিউরে ওঠা গণহত্যা। এ লেখা সেসব বর্ণনার জায়গা নয়। কিন্তু এসব দেখে শুনে নিজের ভেতরে কান্না গিলতে গিলতে শেষে – পরিচিত/অপরিচিত কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রতি শনিবার ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে জড়ো হতে লাগলাম। সেখানে ‘সহনাগরিকদের মুক্তমঞ্চ’ নামে এক অরাজনৈতিক মঞ্চে একটা ম্যাটাডোরে চেপে মুখে এমনকি চোঙা ‘মেগাফোন’ নিয়েও প্রতিবাদ জানাতাম আমরা। প্রতিবাদের কোনও ঠিক করে দেওয়া ভাষা ছিল না সেখানে। বিশিষ্ট থেকে সাধারণ; নানান মানুষের গান কবিতা বক্তব্যের পাশাপাশি আমি আমার সামর্থ অনুযায়ী এমনকি হারমোনিকাও বাজিয়েছি সেই মঞ্চ থেকে। সেখান থেকে একদিন আমি আমার হারিয়ে যাওয়া নবাবের উদ্দেশ্যে এই লেখাটা পড়েছিলাম।

আমাদের সেসব বোকামি (সকলের নিশ্চয় নয়) যে কীভাবে ব্যবহৃত হল, এবং তার যে কি ফল দাঁড়াল, সে ইতিহাস বোধহয় সকলেই জেনে গেছেন এদ্দিনে; আর সেটা এ লেখার বিষয়ও নয়। আমার খালি মনে হয় নবাব কি তখন শুনতে পেয়েছিলেন? শুনে মুচকি হেসে দুর্গা বাজাতে চেয়েছিলেন? একবারও না?

পুনশ্চ: এ লেখাটা লিখব বলে, ক’দিন আগে সেই জায়গাটায় গিয়ে চুপ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঠিক যেখানটাতে তেরো বছর আগে এই বোকা ছেলেটার সাথে একরাম হোসেনের প্রথম দেখা হয়েছিল। ঠিক ‘সোনার কেল্লা’র মুকুলের মতন – কান্না পাচ্ছিল।

ভয়ঙ্কর কান্না পাচ্ছিল।

—————————–

Sumanta Basu

১১ অক্টোবর ২০১৩। শুক্রবার।
দমদম ক্যান্টনমেন্ট

Comments
12 Responses to “দুর্গা”
  1. প্রথম পড়লাম আপনার লেখা। একটু বড় আকারের লেখা হলেই আজকাল কিরকম শুরুতেই হাল ছেড়ে দিই। মনের অস্থিরতার দোহাই পেড়ে ঘুরে বেড়াই এখান থেকে সেখানে, মন বসে না কোথাও। আপনার এ লেখার আয়তন দেখেও ভেবেছিলাম, এ লেখার গতিও সেরকমই হবে বোধহয়। বলা বাহুল্য তা হয়নি। মন্ত্রমুগ্ধ বলতে যা বোঝায় ঠিক সেইরকমটি হয়ে পড়লাম আপনার এই লেখাখানা। একবার নয় দুইবার। আমি জানি আরো অনেক অনেক বার পড়ব। কে বলে ছবি আঁকা আপনার হবে না। এই লেখা ছবিই – তাও স্থিরচিত্র নয়, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ধীর লয়ের ভারী চলমান ছবিসমূহ।
    একরাম, না নবাবজীর কথা আর কি বলব! অবাক হয়ে ভাবি, এক-কে একশো করে দেখানো যে যুগের তপস্যা, সেই যুগে এইরকম ক্ষণজন্মা মানুষরা কোথা হতে আসেন। নিজের বলতে এরা কিছুই রাখেন না। ভুল বললাম – কয়েকটি জিনিস ছাড়া – শিক্ষা, সৌজন্য, আত্মসম্মান, ভদ্রতা। আপনার কবিতায় বলা কথাকটিই মনে এসে যায় – আমরা যারা বিরিয়ানি খাই – / তুমি খেলে কি না খেলে কী আসে যায় বলো?/ এ শহর তোমাকে ভাতও দেবেনা আর। /শরত্‍ শেষ নবাব, যাও। /ভালই করেছ গিয়ে…
    খুব হিংসে করলাম আপনাকে। আপনার লেখার ক্ষমতাকে, আপনার দেখার ক্ষমতাকে, আপনার বলার ক্ষমতাকে আর আপনার টো-টো পার্টি মনটাকে। উৎসবের শুভেচ্ছা, ভালোবাসা, প্রণাম নেবেন।
    – আবির

    • Sumanta Basu says:

      সুহৃদ আবীর,

      আপনি যে পথ ভুলে আমার এ লেখা খানায় এসেছেন, এবং শেষপর্যন্ত ধৈর্য অটুট রাখতে পেরে পড়েছেন, তা জেনে ভাল লাগছে৷ লেখাটা লম্বা হবার কারণেই আমারও ধারণা ছিল এটা অনেকেরই আগ্রহ হারাবে৷ কিন্তু এধরণের লেখার একটা নিজস্ব গতি থাকে, যা লেখকের বাগ মানে না৷ আপনার মতামত উৎসাহ ব্যজ্ঞক৷

      প্রীতি নমস্কার জানবেন৷
      সুমন্ত বসু৷

      • সুমন্ত দা, প্লিজ আমায় আপনি করে বলবেন না, অনেক ছোট আমি আপনার থেকে বয়সে। ‘তুমি’ বলবেন। আমিও বরং ‘তুমি’ই বলি।
        লেখাটা বড় এটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু এত ঝরঝরে ও নির্মেদ যে আগ্রহ হারানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিরকম বলি বলতো – এই যেমন, একটা লম্বা রাস্তা, কিন্তু তার অনেক মোড় আছে, আমি ঐ সামনের মোড় অব্দিই দেখতে পাচ্ছি। ওখানে পৌঁছে আবার নতুন কিছু আবিষ্কার করে অবাক হচ্ছি। এ অনেকটা সেরকম। আজ আবার লেখাটা পড়লাম।
        বিজয়া উৎসবের শুভেচ্ছা তোমার জন্যও রইল আমার তরফ থেকে।

      • Sumanta Basu says:

        🙂 শুভেচ্ছা নিও আবীর৷

  2. Shubhabrata Roy says:

    Khub bhalo laaglo apnar lekha ta pore. Odbhut ekta onubhuti o holo jeta bhasai bojhano muskil. Ami o ek somoy Kolkatai to to kore ghurte bhalo bastam. Aaj sei sujog r nei. Apnar lekhata khub nostalgic kore dilo. Dhonnobad ebong erom r o kichu lekhar opekkhai roilam.

    • Sumanta Basu says:

      অজস্র ধন্যবাদ শুভব্রতবাবু। আপনার মন্তব্য পড়ে ভাল লাগলো। শুভ বিজয়া উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানবেন।

      – সুমন্ত বসু

  3. avra ghosh says:

    ashdharon sumanta. ekdike kharap monitor arekdike amar chokher jol, duye mile aro jhapsa hoye asha lekhata porte porte ‘durga’ raag ta abar mone pore gyalo. ki sonkhipto chhilo sei raager chalon. ar mone pare briddher atitheota. sob haraleo nabab sahebe tar mejaj ti dhore rekhechhilen tar sei rajokio sonkhipto sur laganor motoi.

  4. Darshana says:

    Lekhata shei 2001 er chena shanto, lajuk Sumanta ke abar anek din por-e mone koriye dilo

  5. সুগত লাহিড়ী says:

    কিরকম মন কেমন করা লেখা, সুমন্ত। ওই তারের বাজনার মতই, শব্দ থেমে যাওয়ার পরেও রেশ কাটে কই?

  6. Piku says:

    Apni galpo chaliye jete paren besh lagche..

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

  • Blog Stats

    • 19,879 hits
  • Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

    Join 22 other subscribers
%d bloggers like this: