পালকির গান
‘অ্যায় মেরে পেয়ারে ওয়াতন’ এর সুরে মিশে থাকা আজানের আভাসে, রবাবের শব্দে এমন একটা ছবি চোখের সামনে আঁকা হয়ে যায়, যেটা মরুভূমি ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারে না। এই কাজটা করতে করতে ভাবছিলাম: দ্যাখো, সুর কিভাবে মনের ভেতরে একটা ছবি এঁকে দিচ্ছে; যেন একটা ল্যান্ডস্কেপ তৈরি হচ্ছে – আর সেটা হচ্ছে কোনও কথ্য ভাষার সাহায্য ছাড়াই।
এই ল্যান্ডস্কেপটার পথ ধ’রেই পালকিটা এসেছিল। পালকির গান – কালোত্তীর্ণ, ক্লাসিক। আর ক্লাসিক বলেই হয়ত আমাকে পেয়ে বসেছিল অদ্ভূত একটা ভাবনা। ভেবে দেখছিলাম, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি এ গান থেকে কথাগুলোকে ইরেজার দিয়ে মুছে দেওয়া যায়; সত্যেন্দ্রনাথ আর সলিলের যৌথ সৃষ্টি থেকে যদি সত্যেন্দ্রনাথ কে তুলে নেওয়া যায় – তা হলে কী প’ড়ে থাকবে। যদি এমন হয়, যে বহুশ্রুত কথাগুলোর আর দরকারই হল না; সুরটা কি একাই শ্রোতাকে সবটা ব’লে দিতে পারবে তাহলে? ভাবতে ভাবতে ক্রমশ আমার মনে হচ্ছিল হ্যাঁ, এ সুর একলাই এঁকে দেবে সম্পূর্ণ ছবিটা। কেননা সত্যেন্দ্রনাথ সেখানে না থেকেও থেকে যাবেন; হয়ত আরও বেশি ক’রে থেকে যাবেন। সমস্ত দাঁড়ি কমা রুদ্ধদল হসন্ত সমেত তিনি অনুরণিত হবেন শ্রোতার কানে। শুধু তাঁর লেখা শব্দগুলো সশরীরে থাকবে না; থাকবে সুরের ইঙ্গিত হয়ে।
শুধু এইটুকুই হলে একে অদ্ভূত ভাবনা বলতাম না; কারণ যন্ত্রসঙ্গীত বাজানোর সময় আমরা এটাই ক’রে থাকি। অদ্ভূত বলছি; কেননা ভাবনায় ছিল সুর কে ইনট্যাক্ট রেখে শব্দ কে দৃশ্য দিয়ে রিপ্লেস করার কথা। যে গানের সুর এত ডেফিনিট কথা বলে, তাকে যদি বাংলা হিন্দী গুজরাটি মারাঠির ওপারে নিয়ে ফেলা যায়; সত্যেন্দ্রনাথের লেখা ছবিগুলো যদি সব সত্যি সত্যি সুচারু ভাবে আঁকা যায় আর গানের সুরের সাথে সেগুলো ঠিকঠাক এডিট ক’রে একটা কথাহীন অডিও-ভিস্যুয়াল হিসেবে দেখানো যায় – একটা নতুন ভাষায় কিছু করা যাবে। ‘ছবি এঁকে দেওয়া কথা-সুরের ভাষা’ হয়ে উঠবে ‘কথা এঁকে দেওয়া ছবি-সুরের ভাষা’।
গানটায় তো টুকরো টুকরো দৃশ্যের অভাব নেই। ভিস্যুয়ালাইজ তো করাই আছে, এমনকি স্টোরিবোর্ডও। কিন্তু একাজ করতে হলে অসংখ্য ছবি আঁকতে হবে। একটা আধটা ছবি কাজের নেশার ঝোঁকে মোটামুটি ভাবে এঁকে ফেলতে পারলেও ফর্ম-এ কনসিস্টেন্সি রেখে এত ছবি আঁকতে হ’লে দক্ষ চিত্রশিল্পী হতে হবে। ওটা আমার কম্ম নয়।
কাজেই – ছবি আঁকিয়ে এক বন্ধু তথা সহকর্মীকে ধরলাম। ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সুরের দায়িত্ব আমার, ছবি আঁকার দায়িত্ব তাঁর, আর তারপরে শব্দের সাথে সে ছবি পর পর সাজিয়ে এডিট-টেডিট ক’রে ভিডিও প্রোডাকশনের দায় আমার। তিনি তাত্ক্ষণিক উত্সাহ দেখালেন; কিন্তু ছবিগুলো আর তাঁর আঁকা হয়ে উঠল না। স্বাভাবিক। কারণ কাজটা গুণগত দিক থেকেই শুধু নয়, সংখ্যার দিক থেকেও বিশাল। এত দীর্ঘ গানে ইউনিক ছবির মোট সংখ্যা নেহাত কম হবে না। আর তাছাড়া বিচিত্র এই ভাবনাটা আমার মাথায় যেভাবে নাছোড়বান্দা হয়ে গেঁড়ে বসেছিল; তাঁর মাথাতেও সেটা একই ভাবে দাগ কাটবে; এ ভাবনাটাই তো অবাস্তব। তিনিও তো শিল্পী, কিসের তাগিদে কাজটা করবেন তিনি। কোনও লাভজনক প্রজেক্টও তো নয় ব্যাপারটা, জাস্ট একটা ভাবনার পেছনে ছুটে বেড়ানো। কাজেই ছবির ব্যাপারটা হল না।
এদিকে অত্যুত্সাহে আমি কাজটা করতে শুরু ক’রে দিয়েছিলাম ‘পেয়ারে ওয়াতন’ এর উট-বালি ওয়ালা ভিডিওর কাজ শেষ ক’রে ফেলার পরের দিন থেকেই। এটা একটা ভারী মজার ঘটনা। কোনদিন কোনও যন্ত্রে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা না করলেও গানটা তো ছেলেবেলা থেকে শোনা – মুখস্থ। কাজেই স্ট্রেট অ্যারেঞ্জ করতে বসে গেলাম। কাজ অনেকটা এগিয়েও গেল। একটা ঘোরের মধ্যে যেন কাজ করছিলাম। গোটা গানটায় ঢোল ছাড়াও ট্যাম্বুরিন, কাবাকাস, পিয়ানো, গিটার, ডবল বেস, বাঁশি – একে একে সব ইন্সট্রুমেন্ট বাজানো হয়ে গেছে। পিয়ানোতে একটা গাইড ট্র্যাক-এ গানটা বাজিয়ে রেখে দিয়েছি। সব হয়ে গেলে জোরে জোরে সবকিছু বাজতে থাকা অবিমিশ্রিত ট্র্যাক গুলোকে একটা .WAV ফাইল বানিয়ে কম্পিউটার থেকে আমার ডিজিটাল রেকর্ডারে তুলে নিয়ে তার সাথে ট্র্যাক ওভার ক’রে ক’রে হারমোনিকা আর অন্যান্য এক্যুয়স্টিক বাজনা বাজানো হয়ে গেলে সেই এক্যুয়স্টিক ট্র্যাক গুলো ফের কম্পিউটারে নিয়ে আসতে হবে। তারও পরে শুরু হবে মিক্সিং এর পালা। কে জানে হয়ত সময় সাপেক্ষ আর বেজায় লম্বা প্রসেস; কিন্তু আমি এভাবেই কাজ ক’রে থাকি। কেউ তো আর তাড়া দিচ্ছে না।
এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল রেকর্ডারে ট্রান্সফার করার আগেই কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল বেশ অনেকদিন। কারণ যথারীতি আপিসের কাজের চাপ। এটা যে কেন ভারী মজার ঘটনা; সেটা এবার বলি। বাসায় এক মিউজিশিয়ান বন্ধু এসে আমার মুখে কাজটার কথা শুনে অসমাপ্ত কাজটাই একবার শুনতে চাইলেন – আমিও চালালুম; তাঁর মন্তব্যটাও শোনা হয়ে যাবে এই সুযোগে।
ট্র্যাক শুনে তাঁর হাসি আর থামে না। প্রচণ্ড হাসছেন। আমি ভাবলাম কী হ’ল রে বাবা, এত হাসছে কেন – কিন্তু কারণটা বোঝার পরে শুরু হ’ল আমার হাসির পালা। এবারে আমার হাসি থামতে চায় না। কারণটা আর কিছুই না, মেজর স্কেলে শুরু হওয়া গানটাকে আমি আগাগোড়া মাইনরে বাজিয়েছি, কর্ড প্রোগ্রেশন আর বাকি অর্কেস্ট্রেশনও সেভাবেই করেছি, ফলে মোটেই বেসুরো বা বেমানান লাগেনি কানে। এমন কাজের ঘোর – যে ওই মুহূর্তে ওইটাই আমার কাছে ঠিক সুর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বন্ধু একবার বলতেই ব্যাপারটা যা তা রকমের হাসির হয়ে দাঁড়াল। স্মৃতির ভেতর থেকে গানের আসল সুরটা বেরিয়ে এল প্রচণ্ড হাসতে হাসতে। নিজের করা বিদঘুটে কাজটাকে কী ক’রে নাগাড়ে শুনে যাচ্ছিলাম কে জানে!
এমন হেসেছিলাম সেদিন, যে এই কাজটা নিয়ে আবার বসার ইচ্ছেটাই গেল চ’লে। পালকির গানকে ওভাবেই, ওই অবস্থাতেই ফেলে রেখে দিয়েছিলাম অনেক দিন। পালকির গানে আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই করতে চেষ্টা করছিলাম অন্য কিছু কাজ।
একসময়ে মঞ্চে বাজালেও কবীর সুমনের একটা গানও আমার রেকর্ড করা হয়ে ওঠেনি কখনও। এই অবসরে নতুন করে অ্যারেঞ্জ করে রেকর্ড ক’রে ফেললাম তাঁর তৈরি ‘এ তুমি কেমন তুমি’। বন্ধু অভ্র ঘোষের সুরে আমার নিজের লেখা গান ‘যে হাওয়া হঠাত্ এসে’র অর্কেস্ট্রেশন, আর প্রোগ্রামিং করে ফেললাম। এখনও ভয়েস নেওয়া বাকি; খুব শিগগিরি হয়ত বন্ধুরা সে গান শুনতে পাবেন। আরও এটা সেটা করছিলাম – শুধু পালকির গান ছাড়া।
অথচ মাথার মধ্যে গানটা বোধহয় নাছোড়বান্দার মত পাক খাচ্ছিল। ক্রমাগত খেয়েই যাচ্ছিল। ‘লেখালেখি’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্যের তাগিদ এবং তাগাদায় সলিল চৌধুরির উপরে একটি লেখা লিখতে গিয়ে দেখলাম পালকির গান সেখানেও অবধারিত ভাবে এসে পড়েছে। এসে পড়েছে এই গান নিয়ে আমার কিছু স্টাডি – যার শুরু আসলে অনেকদিন আগেই।
মে মাসের গোড়ার দিকে গানটাকে নিয়ে আবার বসলাম। মোটামুটি ঠিকঠাক ভাবে অর্কেস্ট্রেট ক’রেও আবার একপ্রস্থ ফেলে রাখতে হল। এবারের যতি গরমের কারণে। একে শব্দবহুল এলাকায় থাকি, তায় আমাদের বাড়িতে এসি নেই। আমার ঘরটিও সাউন্ডপ্রুফ নন। কাজেই এক্যুয়স্টিক যন্ত্রে রেকর্ডিং করাটা মোটেই আমার কাছে খুব সুখকর কাজ নয়। সব দরজা জানলা বন্ধ ক’রে পাখা নিবিয়ে রেকর্ড করতে হয়। তবু তন্মধ্যেই প্রতিবেশী কুকুর, কাক, পায়রা, রাজহাঁস, গাড়ি, মোটর সাইকেল, রিকশার হর্ন, ছেলের দল, তারস্বরে বাজতে থাকা মাইক, বিয়ে কিম্বা বাচ্চা হবার আনন্দে আকাশে উঠে ফাটতে থাকা চীনেপটকা, ফেরিওলা, অ্যাম্বুলেন্স, দমকল, মায় এরোপ্লেন অবধি নিজেদের সাক্ষ্য রেখে যেতে চান। যত রাতেই কাজ করি না কেন, রেহাই নেই। দরজা জানলা পাখা সমস্ত বন্ধ করে গলদঘর্ম হতেই হয় – তবুও, বিয়াল্লিশ ডিগ্রীতে সেটা হওয়া বেশ চাপের। তাতা রসির তপ্ত রসে আর যা থাক সংগীতরসের মিশেল নেই!
কাজেই বন্ধ ছিল পালকির গান। এই সেদিন পর্যন্ত। গত রোববারের আগের রোববার গরম একদিনের ছুটি নিলো। সেদিনই রাত সাড়ে নটা থেকে দুটো দশ অবধি দরজা জানলা বন্ধ করে আদিম উত্সাহে চলল পালকির গানের রেকর্ডিং। সোম গেল। তারপর মঙ্গল থেকে মিক্সিং। একটু একটু ক’রে। আপিস থেকে ফিরে যেটুকু পারি। ব্যাস।
বৃহষ্পতিবার নাগাদ দাঁড়াল মোটামুটি একটা শোনার মত কিছু। ওদিকে শুক্রবার থেকে তুমুল ভাইরাল জ্বরে পড়লাম। গলায় প্রচণ্ড ব্যাথা। গা-হাত-পায়েও। তারই মধ্যে কোনও রকমে গত পরশু বিকেলে কম্পিউটারে ব’সে ইউটিউবে তোলার বন্দোবস্ত করলাম গানটাকে।
গত পাঁচ দিনের অ্যান্টিবায়োটিকের ধাক্কায় মাথা বাঁই বাঁই ক’রে ঘুরছে। আজ আর জ্বর আসেনি। ঘুমও না। তবে ভোর বোধহয় আসতে চলল। এ লেখা চার তারিখে শুরু করলেও ঘড়ি বলছে এখন সাড়ে তিনটে। না আসা ভোর কে সাক্ষী রেখেই পালকির গান যেভাবে যেটুকু হ’ল আর যেটুকু হ’ল না সবটুকুই তুলে রাখলাম ওয়েবসাইটে।
একটা কথা না বললেই নয়; এ গান বাজাতে গিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে সবিস্ময়ে শেখার চেষ্টা ক’রে গেলাম – সংক্ষিপ্ততম পরিসরে খাড়া ভাবে কী ক’রে সুর লাগতে হয়। অমন ছোট্ট ক’রে তীক্ষ্ণ আপরাইট সুর লাগাতে পারা লোকটা জাস্ট ইনক্রেডিবলি স্মার্ট! জীবনে এই বিস্ময়টুকু ভাগ্যিস ছিল!
৫ জুন ২০১৪, বৃহস্পতিবার
দমদম ক্যান্টনমেন্ট
দারুণ লাগলো শুনে।
মতামতের জন্য ধন্যবাদ আরাফাত ভাই। উৎসাহ পেলাম।