পথ হারানোর পথে
আমাদের উপমহাদেশের ধ্রুপদী সংগীতের কণ্ঠ ও যন্ত্রশিল্পীরা প্রকাশের মুহূর্তেই সুর রচনা করতে করতে চলেন। টেম্প্লেট তাঁদের প্রিডিফাইণ্ড হলেও সে চলনে আপন বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্র্য ধরা থাকে তাঁদের শিক্ষায়, ভাবনায়, মেধায় ও প্রয়োগের স্বকীয়তায়। পাশ্চাত্যের ক্লাসিক্যাল সংগীতে এই তাত্ক্ষণিকতার স্বতঃস্ফুরণ সেভাবে নেই। সেখানে শিল্পী যা গাইবেন বা বাজাবেন; সেই মুহূর্তেই সে সুরের সৃষ্টি করবেন না। তাঁরা বাজাবেন ভিন্ন একজন সংগীতকারের রচনা; যে সুরের প্রতিটি বাঁক ইতিপূর্বেই পৃথিবীতে এক্সিষ্ট করে। যাঁর যাঁর কন্ঠে বা যন্ত্রে তাঁরা সে সুরের পুনরুচ্চারণ করবেন। সংগীতকার তাঁর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ শিক্ষাকে অনুভুতি, মেধা, অভিজ্ঞতা, ভাবনা ও নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে জারিয়ে সুর রচনা করবেন; তিনি – আদপে নিজেকে প্রকাশ করবেন। আর যাঁরা তাঁর রচনা বাজাবেন? পুনরুচ্চারণ করবেন? তাঁরাও আসলে সংগীতকারকে প্রকাশ করার সাথে সাথে নিজেকেই প্রকাশ করবেন। তাঁরা সৃষ্টি করবেন শব্দ। শব্দের সাথে শব্দ মিশে শব্দান্তরে যাবে তাঁদের প্রকাশ। একটি অর্কেস্ট্রায় ধরা যাক যিনি ট্রম্বোন বাজাবেন, তাঁর সমস্ত শিক্ষা, মেধা, প্রায়োগিক প্রকাশকে ঢেলে তিনি সৃষ্টি করবেন একটি বৃহত্তর প্রকাশের। তাঁর প্রকাশ মিশে যাবে ধরা যাক তিপ্পান্ন জন বেহালা বাদকের প্রকাশের সাথে। একজনের প্রকাশ আরেকজনের প্রকাশকে তরান্বিত করবে স্বরসংগতির প্রয়োগে। এখানে আবার ‘গোঁসাই খুড়োর গিটকিরি’ ব্যাপারটা নেই। এ সুরের জন্মই যৌথ খামারে।
প্রাচ্যের হোক বা পাশ্চাত্যের সংগীতে, ভেবে দেখেছি, সুর জিনিসটা আদপে একটা প্রকাশভঙ্গী। একটা অভিব্যক্তি। একটা ‘নির্ভাষ’ অভিব্যক্তি। ব্যবহারের পৌনপুনিকতা একটি ননভার্বাল অভিব্যক্তিকে অমোঘ করে না তুললে তেমন যেকোনো ইঙ্গিতেরই একটা আপাত অর্থহীনতা থাকে; যা গ্রহীতার কাছে তাকে ইনডেফিনিট করে তোলে। কাজেই একটি সুর আমাকে যা বলে আপনাকে তা নাও বলতে পারে। না বলাটাই স্বাভাবিক। সুরটি আমাদের আদপেই কিছু বলবে কিনা সেটা নির্ভর করবে প্রথমতঃ আমাদের ব্যক্তিগত সংগীতিক সংবেদনশীলতার ওপরে; আর বললেও কী বলবে সেটা নির্ভর করবে আমাদের শিক্ষা, বোধ, মনন, মেধা, অভিজ্ঞতা, হয়ে ওঠা এই সমস্ত কিছুর ওপরে। ব্যক্তি হিসেবে আমরা স্বতন্ত্র, আমাদের রেফারেন্স ফ্রেম স্বতন্ত্র, তাই একই সুর থেকে আমরা দুজন দুরকমের বার্তা পাব। কারণ সুর অ্যাড্রেস করে আমাদের বোধের সূক্ষ্মতর দিকটিকে। আমাদের আবেগকে। যে আবেগের কোনও অভিধান নেই।
আধুনিক সংগীতকে (ঠিক যেমন পল্লীসংগীতকেও), আমার মনে হয় ব্যবহারিক কারণেই কিছুটা ডেফিনিট হতে হয়। এখানে দাঁড়িয়ে সুর আর নির্ভাষ থাকতে পারে না; ‘কথা’র প্রাসঙ্গিকতা সংগীতের আধুনিক আঙ্গিকের স্বল্প পরিসরে অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। কথায়-সুরে গানের ওপরে সংক্ষিপ্ত সংবাদ হয়ে ওঠার দায় এসে পড়ে। এখান থেকেই জন্ম হয় এক সূক্ষ্ম দ্বান্দ্বিকতার। কেননা ‘নিছক সংবাদ’ আর যাই হোক; শিল্প হয়ে উঠতে পারেনা। সংবাদ যা বলে, শিল্প বলে তার চাইতে ঢের বেশি। এই দ্বান্দ্বিকতার বোধ থেকেই সম্ভবতঃ জন্ম নেয় আধুনিক গানের এক নতুন ভাষা। যে ভাষায় ‘কথ্য ভাষার’ সঙ্গে যুক্ত হয় সংগীতের নির্ভাষ সত্ত্বাটিও। তাকে সম্পূর্ণ করে তোলে প্রাসঙ্গিক ধ্বনির আয়োজন। কেননা সুরের মত ধ্বনিও আপাত অর্থহীন কোনও গভীরতর বোধের ইঙ্গিত দেয়।
আধুনিক সংগীতের এই শিল্পভাষা আমাদের দেশে, বিশেষ করে বাংলায় – যেভাবে আপন বৈভবে-বৈশিষ্ট্যে-বৈচিত্র্যে প্রস্ফুটিত হয়ে বিশ্বসংগীতের অকৃপণ দোর খুলেছে; সারা পৃথিবীতে এমনটা আর হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। বাংলার গানে মন্দিরার সাথে নির্দ্বিধায় ডবল বেস বেজেছে। ব্লুজ, জ্যাজ, রক-এন্ড-রোল বা পপ সংগীতে খোল বা পাখোয়াজ নেহাত পরীক্ষামূলক ভাবে বেজেছে বলেও তো শুনিনি।
* * *
এই সব কথাগুলো গোঁফদাড়ি গজানোর পর থেকে আলগোছে মাথার মধ্যে আনাগোনা করেছে বটে, কিন্তু ছেলেবেলায় থেকে ঠিক এভাবে কোনদিন ভেবেছি বলে মনে পড়ে না। সেটা ছিল শোনার দিনকাল। কথা কোয়োনাকো, শুধু শোনো। বার্দ্ধক্য আমার দাদাভাইয়ের (ঠাকুরদার) বেহালার ছড়টাকে চিরকালের মত থামিয়ে দেবার পরে আমাদের বাড়িতে গানবাজনার ফলিত চর্চা আমার অপেক্ষাতেই বোধহয় থমকে ছিল। বাবা তো নয়ই কাকা-জ্যাঠারাও সংগীতের চর্চা করেননি সে অর্থে। কিন্তু গানের তা বলে কমতি ছিল না। রেডিও, রেকর্ডপ্লেয়ার, ক্যাসেটপ্লেয়ার ক্রমান্বয়ে কানে তুলে দিয়েছে সুর। দিশি বিলিতি বাংলা হিন্দী ওড়িয়া অসমীয়া ভোজপুরী কোনকিছু বাছবিচার না করেই। মা নিয়মিত নিয়ে গেছেন সংগীতের অনুষ্ঠানে। ওদিকে প্রতি রবিবার তবলার ক্লাস হয়ে গেলে মামাবাড়িতে সারাটা দিন কেটেছে রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি ঘেঁটে। গুচ্ছের গান শুনতাম – ভাললাগার গানের অভাব ছিল না, কিন্তু বিশেষ কিছু গান ছিল; যখনই বাজতো অন্যরকম হয়ে যেত সব কিছু। কেন যে হতো, কী করে যে হতো, বুঝতে পারতাম না। কিন্তু হতো। এটুকু বুঝতে পারতাম; সুরগুলোর মধ্যে এমন কিছু আছে, যা আর সব গানে থাকে না। বাজলেই মনে হতো, এমন কিছু একটা ঘটছে যেটা অন্য গানের সময় ঘটে না। একটু বড় হয়ে রেকর্ডের কভার পড়ে যখন ‘সুরকার’ ব্যাপারটা বুঝতে শিখছি, তখন দেখলাম অজানা অনুভূতি টেনে আনা সেইসব সুরগুলো একটা লোকেরই করা। ভদ্রলোকের নাম সলিল চৌধুরী।
সলিল চৌধুরীর কোন গান আমি সবার আগে শুনেছি? মনে করা কঠিন। কোনও একটি গান বোধহয় নয়। কোনও একটা গানের কথা আলাদা ভাবে মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে এক অদ্ভুত বিস্ময়ের কথা। মনের মধ্যে পাকিয়ে ওঠা একটা নাছোড়বান্দা নাচের কথা। একটা কালো ঘুরন্ত চাকতির কথা। একটা রেকর্ডের কভারের কথা। একটা কালো ব্যাকগ্রাউণ্ড এর ওপরে পোস্টাল স্ট্যাম্প এর আভাস রেখে ‘লিজেণ্ড অফ গ্লোরি’ অ্যালবামের কভার ডিজাইনের কথা। অমন সুন্দর কাজটি কে করেছিলেন জানি না। আমার এই স্থির বিশ্বাসটির কথা আগেও লিখেছি যে, ক্যাসেট আসার সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ডের এই প্রচ্ছদশিল্পের পরিধিও কভারের আকারের সমানুপাতে ছোট হয়ে গিয়েছিল। আজ যদিও সিডি, ডিভিডি, ব্লু-রের দৌলতে আকার ফের খানিকটা বেড়েছে, কিন্তু শিল্পের মানেটা বোধহয় ততদিনে পাকাপাকি ভাবে আর্ট থেকে ইনডাস্ট্রিই হয়ে গিয়েছে।
নিজে যখন একটু আধটু গানবাজনা শেখার চেষ্টা করছিলাম, এই ভদ্রলোক অপার বিস্ময় হয়ে আমার মাথায় পাকাপাকি ভাবে চেপে বসেছিলেন। এতদিন শুধু শুনতে গিয়ে যে গানগুলো ভালবেসে এসেছি; বাজাতে চেষ্টা করে হল নাজেহাল দশা। সলিলের সংগীত আমাকে অস্থির করে তুলল। একে এড়িয়ে যাবার সাধ্য আমার ছিল না।
আজ এত বছর পরের এক ক্লান্ত গ্রীষ্মের নির্ঘুম মধ্যরাত এ লেখা লিখতে বসিয়ে আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছে – কেন ছিল না হে?
* * *
ভেবে দেখেছি সলিল চৌধুরীর গানে ছন্দ একটা সাংঘাতিক এলিমেন্ট। ভেতরে একটা নির্লজ্জ নাচের চোরাস্রোত সারাক্ষণ বয়ে যাচ্ছে; যেটা আমার মতন হুঁকোমুখো হ্যাংলাকেও নচিয়ে ছাড়ছে। এই নাচটা কিন্তু উলঙ্গিনীর রণরঙ্গের নাচ নয়। চিত্রাঙ্গদা বা শ্যামা শাপমোচনের অশ্রুমোচনও নয়; প্রেম, বিদ্রোহ, বিরহ, স্ফূর্তি, বেদনা, ছেলেমানুষি, একফালি রোদ্দুরের মত নিপাট আনন্দ, বৃষ্টিভেজা শীতের সকালের মত বিমর্ষতা, এমনকি মৃত্যুর মত অমোঘ ডিপার্চার ও সেলিব্রেটেড হয় তাঁর চির-‘ঝর্ণার ঝর্ঝর ছন্দে’র নৃত্যশীলতায়। সেই সেলিব্রেশনের পার্টিতে, ঐকিকের সাথে দেখা হয়ে যায় ভূমার। আর সেখানেই এ নাচ হয়ে ওঠে মানব সভ্যতার মত, পৃথিবীর মত সনাতন – নিলাজ, নাছোড়, অমোঘ!
উপমহাদেশের মিউজিক ইনডাস্ট্রির সলিলোত্তর অধ্যায়ে, যেভাবে সুরের প্যারালাল আলাদা ভাবে রিদম কম্পোজ করার একটা চল দেখা দিয়েছিল – সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে জনপ্রিয় সংগীতকাররা একাধিক দিকপাল যন্ত্রশিল্পীদের সাহায্য নিয়ে যেভাবে জটিল, শক্ত – প্রায় শিশিবোতলের মত সব রিদম প্যাটার্ন বানাতে শুরু করেছিলেন; সলিল কিন্তু তাঁর সময়ে, কখনো সেভাবে রিদমকে মূল কম্পোজিশন থেকে আলাদা করে বাড়াবাড়ি রকমের জটিল বানিয়ে বাড়তি কেরামতি দেখিয়েছেন বলে আমি মনে করতে পারি না। বরং তাঁর সুরের ‘ভেতরকার নাচ’ই রিদমকে ডিফাইন করে দিত বলে আমার মনে হয়েছে। ফলে সাধারণ ভাবে, তাঁর তৈরি মেলোডি রিদম-এর দাসত্ব তো করেইনি, বরং সুর-ছন্দের কিছু নিবিড় সম্পর্ক রচনা করে গিয়েছে। আমার কাছে বিস্ময় হয়ে উঠছে, যখন দেখছি রিদমানুগত্যহীনতার বোধে অবিচল থেকেও সলিল ‘ছন্দের প্রয়োগে’ আনছেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, নিবিড় নিরীক্ষা ও নানান সাংস্কৃতির একটা জরুরী মিশেল। এই মিশেলটা তথাকথিত বহিরঙ্গের ‘ফিউশন’ নয়, মেধার ল্যাবরেটরিতে এটা ঘটে গেছে তাঁর সংগীতের অন্তরাত্মার স্পন্দনে।
সবিতাদেবীর গাওয়া ‘ঝিলমিল ঝাউয়ের বনে ঝিকিমিকি’ – ঠেকাটা মনে করে দেখুন; সুরের ওপর ভর করে, বাংলা গানে, সম্পূর্ণ ভারতীয় মেজাজ বজায় রেখে এভাবে ছন্দে ‘স্যুইং’এর প্রয়োগ করতে কই আর তো কাউকে দেখিনি। হয়ত বা কেউ করেছেন, কিন্তু সেটাকে এভাবে সিগনেচার করে নিতে পেরেছেন কি? ‘হাল চাল ঠিক ঠাক হ্যায়’, ‘চিল চিল চিল্লাকে কাজরি সুনায়’ থেকে ‘সাত ভাই চম্পা’ – মোটামুটি ভাবে ছন্দের একই প্রয়োগরীতিকে মেনে তৈরি। আমার কেন জানি মনে হয়, এক নিঃশ্বাসে মনে পড়ে যাওয়া এই উদাহরণগুলো স্বভাবে যেন এক ‘অ-বাংলা’ প্রগলভতার। এমন এক সাংগীতিক ভাষার; যে ভাষা মননে নবীন – যার গাম্ভীর্যের কোনও দায় নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য, এই ‘স্যুইং’ এরই যত্সামান্য আভাস মেলোডির শরীরে রেখে সেই একই সলিল এক দার্শনিকতার নৃত্যশৈলীও হেলায় ছন্দে এঁকে দিতে পারলেন। ‘দুরন্ত ঘূর্ণির’ কথা মনে করুন; সঞ্চারীতে এসে হেমন্তবাবু গাইছেন ‘কখন কাঁদায় আর কখন ভোলায়’ – ছিয়াশির মারাদোনার বাঁ-পাটা মনে পড়ে?
* * *
পাণ্ডিত্যস্কোপের ফুটোয় চোখ রেখে আপনিমোড়লি জন্ম-‘বাঙালি’ এই আমিটা হাবিজাবি বলতে বলতে ‘স্বভাবে অ-বাংলা’ কথাটা কি করে জানি বলে ফেললাম। আমার কেন জানি মনে হয়, সংগীতের দেশ ভারতবর্ষ সলিলের চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন ভাবে মিশে ছিল, যে সেটা তাঁর ‘বাঙালি’ সত্ত্বাটাকে আপারহ্যান্ড নিতে বিশেষ সুযোগ দেয়নি।
মোত্জার্ট এর চঞ্চলতা তাঁকে ভাষা দিয়েছে – সত্যি। কর্ড ও হারমনি প্রয়োগে তাঁর মত পাণ্ডিত্য এবং মেধা ভারতীয় সংগীতকারদের মধ্যে খুব বেশি ছিল না – সত্যি। বেঠোফেনের তৈরি সুর তাঁর হাত ধরে বাংলা গানের আস্থায়ী অন্তরার মাঝখানে জায়গা করে নিয়েছে – সত্যি। রাশিয়ান রেড আর্মির মার্চিং সং –এর স্পিরিট থেকে চার্লস স্পেনসর চ্যাপলিনের তৈরি ব্যালের প্রশান্তি তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এটাও সত্যি। টারজান, অরণ্যদেব, মহিষাসুর, ক্যাপ্টেন স্পার্ক, হিজিবিজিবিজ… সব সত্যি। তথাপি তিনি কিন্তু কেবলই ‘বিলেত ফেরতা সায়েবি সুর’ ভাঁজতে থাকেননি। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তা পুরো মাত্রায় আধুনিক ভারতীয় সংগীত। তাঁর জিনিয়াস মগজ যেভাবে গ্লোবাল থটস থেকে লোকাল অ্যাক্টসের মন্তরটা শিখে নিয়েছিল, পন্ডিতেরা বলেন তার পেছনে নাকি মার্ক্সীয় দর্শনের হাত ছিল। হয়ত ছিল।
* * *
সলিলের গানে আমি কিন্তু দূরের ইউরোপ বা কাছের বাংলার থেকেও বেশি করে গোটাগুটি আমার দেশটাকে তার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সমেত বারে বারে খুঁজে পাই। আপন বৈশিষ্ট্যে টইটম্বুর ‘বাংলা’র প্রকৃতি এবং লোকসমাজ নিশ্চই তাঁর গানে ষোলআনা উপস্থিত, তবে তার স্পন্দনেও আমি কেন জানি খুঁজে পাই একটা ‘অ-বাংলা’ ভারতীয়তার সমাবর্তন। অথচ লোকে, বিশেষতঃ বাঙালি ভদ্রলোকে, দেখেছি সলিল চৌধুরীকে পাশ্চাত্যের প্রভাবে থাকা একজন জিনিয়াস সংগীতকার বলে দেখতেই বেশি পছন্দ করেন। ভাবখানা এই রকম – আরে আমাদের কোদালিয়ার সলিল চৌধুরী প্রভাবে থাকলে সাদা সায়েবদের প্রভাবে থাকবে – ‘মেড়ো’, ‘খোট্টা’, ‘তেলেগু’, ‘গুজ্জু’ বা ‘পাঁইয়া’দের প্রভাবে থাকতে যাবে কোন্দুক্ষে?
ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে ‘বঙবচেতনে’ অন্তর্লীন এইরকম কোনও উন্নাসিক প্রাদেশিকতা কি এর একটা কারণ হতে পারে? একজন সংগীতকারের অভিধাকে সমাজবিজ্ঞানের চোখে দেখার দায় কি কারুর আছে?
আমি বরং ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি, সলিল চৌধুরীর প্রাক্কালে রেকর্ডেড (আধুনিক) বাংলা গানের ছন্দের সাউন্ডস্কেপ কীরকম হত। ব্যাতিক্রমও নিশ্চই ছিল, কিন্তু সাধারণ গুণণিয়কও তো কিছু ছিল। আমার স্মৃতিতে যা আসছে, তা মেজাজে হয় বাঙালি, নয় ইউরোপীয়। আধুনিক বাংলা গানে ছড়টানা যন্ত্রের সাথে রিদম ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে হয় তবলা, পাখোয়াজ, মন্দিরার পেলব সুরেলা ধ্বনির প্রচলন ছিল; অথবা ছিল সাহেবী মেজাজে পিয়ানো, ডবল বেসে তাল রেখে যাওয়ার অভিজাত মিনিমালিজম। ড্রামস এসেছে পরে। উপযোগের অপটিমাম সদ্ব্যবহার না হলেও তাল রাখতে গিটারের ব্যবহারও হয়ত হয়েছে অল্প বিস্তর। বাংলার লোকায়ত সঙ্গীতে বরং সেদিক থেকে তারের এবং চামড়ার তালযন্ত্রের বিপুল বিচিত্রতা ছিল।
আমার আশৈশব কানে সলিল কিন্তু ভারতীয় ছন্দে তালযন্ত্রের ধ্বনি প্রয়োগ করতে গিয়ে যন্ত্র হিসেবে বাঙালিয়ানার থেকেও ভারতীয়তাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। তবলা-পাখোয়াজ এর ধ্বনিগত পেলবতার থেকেও একটু ‘কড়াপাকের’ পাঞ্জাবী ঢোল, ঢোলক, কাড়া-নাকাড়া, নাল, মাদল, ডাফ, ডুগি, বাংলা সহ ভিন্ন প্রদেশের লোকায়ত তালযন্ত্র (বিদেশী তাল যন্ত্র বলতে ডবল বেস, পিয়ানো গিটার তো ছিলই, পিজিকাটো বেহালা, ড্রামস, বঙ্গো, থুম্বা, কঙ্গো, টিংগ্লস, শেকার – এগুলো বোধহয় পরের দিকে এসেছে, প্রথম দিকে মার্চিং স্টিল ড্রাম, ম্যারাকাস ইত্যাদি দিয়ে কাজ চালানো হতো) কীভাবে বাংলা গানের সাউন্ডস্কেপের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠতে পারে; তাঁর আগে কেউ (বিচ্ছিন্ন ভাবে হয়ত করে থাকতেই পারেন কেউ কেউ) সেটা সংখ্যায় এবং গুণে – নাগাড়ে এত ভাবে এক্সপ্লোর করেছেন কী? আমাদের সাউন্ডস্কেপে এদের স্থায়ী প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন কী?
* * *
সারা জীবনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে তালের যে বিভিন্নতার প্রয়োগ করেছিলেন, অত ভ্যারাইটি সম্ভবতঃ আজও দ্বিতীয় কোনও আধুনিক কম্পোজারের নেই। তালের ভ্যারাইটি অত না থাকলেও আমার ধারণা, সলিলের ভ্যারাইটি ছিল ছন্দের প্রয়োগে। অজস্র অ-বাংলা ভারতীয় ছন্দকে হেলায় এনে ফেলেছিলেন বাংলা গানের শরীরে; নৃত্যশীলতার নিবিড় পরিসরে। কিসের সাথে কী প্রয়োগ করে কী ঘটিয়ে ফেলবেন; ঘটবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সেটা ভাবা যেত না। জিনিয়াসরা এমনই হন।
কবীর সুমন আমার সময়ের জিনিয়াস। সংগীতে নৃত্যশীলতা প্রসঙ্গে, এমনকী সলিলের সংগীত প্রসঙ্গেও অনেকবার তাঁকে মার্কিন কবি ও দার্শনিক এজরা পাউন্ড এর একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে শুনেছি; সেটা এ লেখায় গুরুতর রকমের প্রাসঙ্গিক – “Music begins to atrophy when it departs too far from the dance… poetry begins to atrophy when it gets too far from music.”
আমাদের খুব চেনা, সলিলের নিজের ভাষায় ‘ইতিহাস সৃষ্টি করা’, তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁর ঐতিহাসিক রচনা – ‘হেই সামালো ধান হো’। ভদ্রলোকের কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরে দূরে ঘোরা বেচারা আমি; ভেবে পাইনা গুজরাটের উত্সবের ডান্ডিয়া নাচের ছন্দ বাংলার কৃষকের দাবী আদায়ের মিলিট্যান্ট সংগ্রামের গানে প্রয়োগ করার কথা ভদ্রলোকের মাথায় কেনই বা এল আর কীভাবেই বা এল!
মারাঠি লোক ঘরানার নাচের ছন্দ লাবণি বা লাউনি বোধহয় সলিলের অস্থিমজ্জায় বাজতো। একটু আগে যে স্যুইংটার কথা লিখেছি, লাউনির মধ্যেও কিন্তু সেটার একটা হিন্ট আছে। কত গানে যে সে নাচ উঁকি দিয়ে গেছে তার হিসেব নেই। কিন্তু তাকে ভেঙে, তার লয় কমিয়ে, কীভাবে তাকে দিয়ে অন্য সংগীতিক ভাষায় কথা বলানো যায় – এই অবিশ্বাস্য প্রয়োগের নামটি; ধরণীতে অপরিচিতই ছিল। খামাজ রাগের ওপরে বাঁধা ‘না যেও না, রজনী এখনো বাকি’ – গানটা নিজেই সেই মূর্তিমান অবিশ্বাস। জাস্ট ইররিপলেসেবল ছন্দ। সিম্পল কাহারবা বাজলে হবে না; মাটি হয়ে যাবে সব।
অবিশ্বাস্য এই গানের সঞ্চারী। কোনও রকম অন্তর্মিল ছাড়া জাস্ট অ্যান ওয়ান লাইনার স্টেটমেন্ট – “যে কথা বলিতে বাজে / যে ব্যাথা মরমে কাঁদে / সে কথা বলিতে ওগো দাও” অথবা হিন্দীতে, “ক্যায়সে রিমঝিম মেরে সাজন / পেয়াসি পেয়াসি ইয়ে দো নয়ন / তেরে হি খোয়াবো মে খো গয়ে”
| – – স ব { গ ম প – | ব গ ব বপহ্মপ | – প হ্ম – |
| – – ব হ্ম | ধ ন নর্ব নর্ব | ন ধ ধ ন | র্স ন ধ ন |
| ধপ – হ্ম ধ | প – হ্ম র্স | ম – গম বগ | ( প – গপ গপ |
| স – স ব )} প – – – | – – – – |
কী করে? – কী করে? – কী করে? – কী করে? এই কথা গুলোকে এই তালে এই ছন্দে এই ভাবে ভাঙতে পারে একটা মানুষ? সময়ে সময়ে আমার মনে হয় এই সঞ্চারীটা আসলে বোধহয় পৃথিবীতে ছিলই না। ছেলেবেলা থেকে যেটা শুনেছি, আসলে সেটা কুহক, সেটা মায়া, সেটা ইল্যুশন –
আমি জানি, এই অবিশ্বাস নিয়েই আমি মরবো।
ছন্দের প্রয়োগে নিয়ে আসতেন দ্বান্দ্বিকতার বোধ – বৈপরীত্যের সহাবস্থান। ‘পথে এবার নামো সাথী’ গানটাতে দেখুন, উনি একটা সিম্পল খেলা খেলেছেন শব্দ গুলোকে স্ক্যান করেছেন এমন ভাবে, যাতে ঠিক ইমিডিয়েট আগের ‘বার’এর শেষ মাত্রা থেকে সবকটা শব্দে ঢুকতে হয়। ব্যাপারটা এরকম:
– – প || থে – এ | বা র্ না | মো – সা | থী – প | থে – হ | বে – এ | প থ্ চে | না – – |
এর ফলে হচ্ছে কী, সুরটার আর এলিয়ে যাবার জো থাকছে না মোটে। ‘বিশ্রাম’ আর হচ্ছে না, ‘সাবধান’ হয়েই থাকতে হচ্ছে। গানটাও একটা গতি পাচ্ছে। একটা মিছিলের মত গানটা যেন নিজেই এগিয়ে চলেছে।
– – জ | ন স্ রো | তে – না | না ন্ ম | তে – ম | নো – র | থে – র | ঠি – কা | না – – |
সহসা চাল পাল্টে ছন্দটা তালের প্রথম মাত্রা কে ধরলো: | আ – ০ | ০ ০ ০ | ০ ০ ০ | ০ –
সুরের মিছিল জনতার হাতে হাতে দাবীর নিশান হয়ে একটু দুলে উঠল যেন; পরক্ষণেই দারুণ কনভিকশনের সাথে সমস্ত শরীর নিয়ে ফিরে গেল হাঁটার গতিতে, হ | বে – চে | না – হ | বে – জা | না – – |
গতির ছন্দে তিনি শান দিয়েছেন তাঁর অস্ত্রে। মাথায় ভেতরে খুলে দিয়েছেন ভাবনায় বিচিত্র বিস্ময়ের দরজা। ‘পথে এবার নামো সাথী’ ছিল সিক্স/এইট, আর পায়রার গানটা; ওটা ছিল ফোর/ফোর। ‘শান্তি’ নিয়ে গান, কিন্তু কোথায় শান্তি! দু-আড়াই অকটেভ জুড়ে এ গানের সুর চঞ্চল পায়ে ছুটে চলেছে নিষেধের পথে। এমনকি নীল শূন্যের মহাকাশও সেই চঞ্চলতার সাক্ষী থেকে যাচ্ছে। বন্ধুদের কাছে মার্জনা চাইছি; লিখে সুরের উদ্ধৃতি দিতে গেলে স্বরলিপি লেখা ছাড়া উপায় থাকে না। মিউজিক নিয়ে কিছু বলতে গেলে তো মিউজিক্যালিই বলতে হয়, কাজেই -। স্বরলিপি ব্যাপারটা যাঁদের অপরিচিত; তাঁদের বলব, আরও একবার শুনে নিন না এই সুযোগে – লক্ষ্য করুন সব শব্দের স্ক্যান গুলো কেমন তালে তালে পড়ছে –
উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা / সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে / চঞ্চল পাখনায় উড়ছে:
স গ ব স | ব ম – – | ম ধ ণর্স ণধ | প ব – – | প গ ম ব | গ স – – |
নিঃসীম ঘন নীল অম্বর / গ্রহ-তারা থাকে যদি / থাক নীল শূন্যে / হে কাল, হে গম্ভীর, / অশান্ত সৃষ্টির / প্রশান্ত মন্থর অবকাশ / হে অসীম উদাসীন বারোমাস – কিন্তু কোথায় গম্ভীর? কোথায় প্রশান্ত? কোথায় মন্থর? সুরের ভাষা চেনাচ্ছে পায়রার পাখনার চঞ্চলতা:
স প বগ ম | ব ন্ – – | বগ পধ নর্ব র্সন | প গ স ব | সর্স :র্স র্স প | গপ :গ প র্গ | র্বর্ব :র্স ন ধ | গম ধ – – | ণধ প মগ ব | গব স – এই কোমল নি-টার মধ্যে যেন অসীমের ঠিকানা লিখে পায়রার পায়ে বেঁধে ছেড়ে দিলেন তিনি; অসীমের উদ্দেশে এবার পায়রা উড়ে যাবে সূর্যের রৌদ্রে স্নান করে –
এইবার – সেই মাহেন্দ্রক্ষণ; সলিল আবার খেলে দিলেন ‘পথে এবার নামো সাথী’র খেলাটা – ছন্দের স্ক্যান পাল্টে শব্দ গুলোকে আনলেন আগের ‘বার’-এর শেষ মাত্রা থেকে – এটাই হয়ে দাঁড়াল গানটার জান, গানটার ধরতাই।
সূর্যের রৌদ্রের উদ্দাম উল্লাসে / তুমি নেই আমি নেই কেউ নেই কেউ নেই
স | গ – :ব ন্:স | ব – – স | ধ – :ম ম:গ | ব – – গম | প বগ ম ন্:স | ব সধ্ ন্ –
সংগীতের ভাষা যেন কানে কানে বলে দিচ্ছে – ‘ওই শান্তি, ওই আনন্দ ওই অনন্ত জাগছে’। এইবার – ন্যারেটরের পার্স্পেক্টিভে ফিরে সলিল কনক্লুশন করছেন – ‘ওড়ে শুধু এক ঝাঁক পায়রা’; ছন্দকেও ফিরিয়ে নিয়ে আসছেন শুরুর জায়গায় – তালে তালে বলছেন: ধধ পপ ম গ | বগব স – –
ছন্দের একই প্রয়োগরীতির ওপরে ভর করেই সলিল দুটো গানকে দিয়ে দুরকমের সংগীতিক ভাষায় কথা বলালেন – দেখালেন বৈপরীত্যের সহবাস কিভাবে তৃতীয় সংগীতিক ইঙ্গিতের অবতারণা করে, যার কথা এ লেখা শুরু করার সময় বলার চেষ্টা করেছি।
বিস্ময়ের শেষ নেই। লতা মঙ্গেশকর কে দিয়ে ‘ও মোর ময়না গো’ তৈরির সময় কিউবার নাচ ‘চা চা চা’র ছন্দের স্পিরিটটাকে নিয়ে শুধু একটা গিটারকে ব্যবহার করছেন ছন্দ রাখতে। বাংলা গানে তো বটেই, আধুনিক ভারতীয় গানে এটা ছিল একটা নতুন স্টেটমেন্ট। নতুন স্টেটমেন্ট ‘খোল’ এর মত একটা ইন্সট্রুমেন্টকে ‘নিশিদিন নিশিদিন’ গানে ওভাবে ব্যবহার করে ফেলাটাও। আমার কেন জানি মনে হয় কীর্তনাঙ্গ ব্যতিরেকে ‘খোল’এর অমন ব্যতিক্রমী ব্যবহার করার জন্যে তিনি প্রাণপনে ‘কোমল নি’ স্বরটির ওপরে নির্ভর করেছিলেন – নয়ত ব্যাপারটা হতো? কে জানে, আমার ঠিক পার্সেপশনে আসে না।
‘ধিতাং ধিতাং বোলে’তে দেখছি – বাংলায় হেমন্তবাবুর গানে যখন অর্কেস্ট্রেট করছেন, বাঁশি আর মাদলের ছন্দ ব্যবহার করছেন। স্বভাব-গম্ভীর মাদলের শব্দ হেমন্তবাবুর ব্যারিটোন কণ্ঠকে রাজ সমাদরে গ্রহণ করছে। নাচ থাকছে, কিন্তু উচ্ছ্বাসের বহিপ্রকাশের আভিজাত্য মেনে। হিন্দীতে এই একই গান যখন হচ্ছে, গান শুরু হবার আগে অনেক তালযন্ত্রে একটা কোলাজ রচনা করছেন, কিন্তু গান শুরু হলে বাংলার গাম্ভীর্য ভেঙে সিম্পল ডবল দাদরায় চলে যাচ্ছেন – হিন্দী শব্দের ধ্বনিগত অভিঘাতে যেটা একটা মানানসই চেহারা নিচ্ছে। এই অবধি তাও ঠিক ছিল – কিন্তু তিনি তো সলিল চৌধুরী। একই কাজের পুনরাবৃত্তি তাঁর স্বভাবে সয় না। মালয়ালম ভাষায় ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’র সুর তিনি যখন পি সুশীলা (সম্ভবতঃ) কে দিয়ে গাওয়াচ্ছেন – ‘তাইয়াম তাইয়াম তা রে’; তিনি শুরুতে একটা তাল ছাড়া কন্ঠের প্রিল্যুড রাখছেন। যাকে একটা বাঁশি দিয়ে ফলো করাচ্ছেন। হিন্দির মত শুরুতে তালের কোলাজটা রাখছেন, তারপর ঢোলকে ডবল দাদরায় ঢুকে একাধিক ম্যাণ্ডোলিনের একটা চমত্কার পিস তৈরি করছেন। তার পরে বাঁশি এবং কোরাসে বোধহয় প্রিল্যুডটা আরেকটু প্রলম্বিত করে একটা অমোঘ নীরবতায় এনে ফেলছেন। যেটা মনে মনে চার গুনিয়ে সটান গানটাকে ধরিয়ে দিচ্ছে। ঠিক এইখানে ভদ্রলোক একটা ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করছেন। একটা পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়নের কর্ড প্রতি পঞ্চম মাত্রায় অর্থাত্ অফে অফে একটা করে গুঁজে দিচ্ছেন। ব্যাপারটা ভাবতে সহজ কিন্তু এর ফল যেটা দাঁড়াচ্ছে; ছন্দের পরিবর্তন সুরের জিওগ্রাফিটাকেই পাল্টে দিচ্ছে। চোখের সামনে যেন ধরা দিচ্ছে গোয়ার সমুদ্র সৈকতের উচ্ছ্বলতার ছবি। কার্নিভালের স্পিরিট। সলিল শুধু ছবিটা এঁকে দিয়েই কাজ শেষ করেননি। রঙ করেছেন হারমনি দিয়ে। একটি bass কণ্ঠস্বরকে এমন ভাবে তিনি ব্যবহার করছেন; যেভাবে একজন চিত্রকর গাঢ় রঙকে হাইলাইটারের ব্যতিক্রমী কাজে ব্যবহার করেন।
* * *
সত্যজিত্ রায় একটা সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, আঙ্গিকের দিক থেকে চলচ্চিত্রের সবচাইতে বেশি ঘনিষ্টতা সংগীতের সাথে। কেননা দুটোই সময়ের মাপে বাঁধা। একটা সিনেমার যেমন একটা নির্দিষ্ট ডিউরেশন থাকে, সংগীতেরও তাই।
শটের পরতে পরতে সিনেমার যেমন একটা পৃথক ভাষা আছে, আধুনিক সংগীতেরও তাই। এলেখার শুরুতে আধুনিক বাংলা গানের এই শিল্পভাষা নিয়েই একটা বড় ভূমিকা করেছিলাম।
আমার মনে হয়, সলিল চৌধুরীর আগে তৈরি হওয়া আধুনিক বাংলা গানের ভাষা, আর সলিলের গানের সাংগীতিক-ভাষার মধ্যে কোথাও একটা মৌলিক তফাত আছে। বোঝা দরকার যে ব্যাপারটা খারাপ-ভালোর নয়। এটা আঙ্গিকের তফাত, ভাষার পার্থক্য।
রবীন্দ্রনাথ, ডিএল রায়, অতুলপ্রসাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত – প্রত্যেকের সংগীত ভাষায় অ্যাপারেণ্ট মৌলিকত্ব থাকলেও একটা সাধারণ গুণণীয়কও বোধ হয় ছিল। আমার কাছে যেটা মনে হয়, কমিউনিকেশনের ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক। রবীন্দ্রনাথ যখন তৈরি করছেন – ‘তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে’, ‘চিনিলে না আমারে কী’, ‘মরি হায় চলে যায়’ বা ‘যখন এসেছিলে অন্ধকারে’, তার সংগীতিক ভাষা কথা বলছে না এমনটা নয়, আমার মনে হচ্ছে সেটা আসছে একটা স্টেটমেন্টএর মত। সেই স্টেটমেন্টএ যেন একটা অন্তর্লীন সুপিরিয়রিটির বোধ লুকিয়ে আছে। তাই সে ‘কথা’ নয়, ‘বাণী’। সে ভাষায় কথোপকথন কম, বর্ণনা অনেক বেশি। ব্যক্তির ভাবনা, ব্যক্তির উচ্চারণে হাত থেকে হাতে বুক থেকে বুকে ছড়িয়ে পড়ছে। ডিএল রায়ের ‘মলয় আসিয়া কহিয়া গিয়াছে’, ‘আমরা এমনি এসে ভেসে যাই’, ‘আজি এসেছি, আজি এসেছি’ বলুন, অতুলপ্রসাদের – ‘সে ডাকে আমারে’, কাজী নজরুলের ‘বল রে জবা বল’ হোক বা ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম’, সুরসাগর হিমাংশু দত্তর ‘তোমারি বিরহে জানি গো জানি’, ‘প্রেমের সমাধিতীরে’, ‘বর্ষার মেঘ নামে’ – আমি random স্যম্প্লিং করার চেষ্টা করছি মাত্র – হয়ত ব্যাতিক্রমও ছিল, তবে সাধারণ ভাবে তাঁদের সংগীত ভাষা আমার মনে হয় অনেক বেশি ‘ন্যারেটিভ’। যেমন কবিতার ভাষা। যে কারণে হয়ত আধুনিক বাংলা গান ‘কাব্যগীতি’র অভিধাও পেয়েছিল।
সলিল চৌধুরীর গান সেই অর্থে সংলাপধর্মী। অনেক বেশি সিনেমার চিত্রনাট্যের কাছাকাছি। তাঁর সংগীত-ভাষা চলচ্চিত্রের ভাষার অনেক কাছাকাছি। Layered। বহুস্তরীয়। হতে পারে সেটা যন্ত্রসংগীতের কারণে। সংগীতের ভাষার চাপান-উতোরে, সলিল যত পাত্র-পাত্রী নিয়ে ঘর করেছেন; আগের সংগীতকাররা তো সেটার সুযোগ পাননি সেভাবে। তাঁরা তো সেভাবে অর্কেস্ট্রার সাহায্য পাননি। তাঁদের সংগীতের ভাষা ছিল মূলতঃ গানের ভাষা। তবু, তাঁদের সুর যে কথাকে নিছক কমপ্লিমেণ্ট করার মধ্যেই থেমে থাকেনি, আরও গভীরতর বোধের ইঙ্গিত দিতেও সার্থক ভাবে সক্ষম হয়েছে সে কথা বলাই যায়। তাই তাঁদের ভাষাকেও আধুনিক সংগীতের ভাষা হিসেবেই দেখার চেষ্টা করলাম।
একই গানের শরীরে অজস্র ইঙ্গিতের বৈপরীত্যের সহাবস্থান কিভাবে তৃতীয় ডাইমেনশনের সংগীতিক ইঙ্গিতের অবতারণা করে, ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’র যে উদাহরণটা দিয়েছি, তাতেই দেখানোর চেষ্টা করেছি। সলিল চৌধুরীর সংগীত-ভাষা মূলত দ্বন্দ্বময়। এই কারণেই তাকে আমার চিত্রনাট্যের ভাষার কাছাকাছি বলে মনে হয়। সিনেমায় যেমন দুটো আলাদা শট পাশাপাশি বসে তৃতীয় ইঙ্গিতের জন্ম দেয়, ব্যাপারটা সেই রকম।
আমি আবার বলছি, ব্যাপারটা জাজমেন্টাল নয়, খারাপ ভালোর নয়; এটা – আঙ্গিকের ভিন্নতার প্রসঙ্গ।
* * *
আমার সময়ের জিনিয়াস, কবীর সুমন। যিনি অবিসংবাদিত ভাবে গানের কম্যুনিকেশন কে নিয়ে গেছেন এক ভিন্নতর প্রেক্ষাপটে। আমার বোধে, তাঁর যে সংগীত-ভাষা, সেটা সলিলের থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। তিনি দেখিয়েছেন, গান দিয়ে একটি বিষয়কে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে স্বল্পতম পরিসরেও সুরের ইঙ্গিত কিভাবে ইনফরমেশন হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে তিনি বরং রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ট। কিন্তু আরও আধুনিক – তাঁর সংগীত-ভাষা খবরের ভাষা তো বটেই, দরকার হলে এমনকি প্রবন্ধের ভাষাও হয়ে উঠেছে কোথাও কোথাও। নিজের গানের শরীরে অন্যের তৈরি সুরের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, শ্রোতাকে বিষয়ে রাখার জন্যে। বিষয়টাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে। সার্থক শিল্প সৃষ্টি করার জন্যে। দুটো উদাহরণ মনে পড়ছে – ‘বাঁশুরিয়া বাজাও বাঁশি’ তে ‘প্রাণে গান নাই মিছে তাই রবিঠাকুর মূর্তি গড়া’। এখানে ‘প্রাণে গান নাই মিছে তাই’ তে রবীন্দ্রনাথের সুরটাকেই তিনি উদ্ধৃত করছেন। কী চমত্কার ভাবনা; কী চমত্কার প্রয়োগ! আর যেটা মনে পড়ছে সেটা দূরদর্শনের জন্যে তৈরি ‘ছুটি ছুটি’ অনুষ্ঠানের টাইটেল সং। কী আশ্চর্য সমাপতন, এখানে তিনি উদ্ধৃত করছেন সলিল চৌধুরীকেই। কেননা তার কয়েকদিন আগেই সলিলবাবুর মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। সুমনের সমকালীনতার সৃজনে থেকে গেছে তার উল্লেখ। এবং ট্রিবিউট টু হিজ মায়েস্ত্রো। ‘মনেপড়ে তাঁর আরেকজনের কথা / ধিতাং ধিতাং বোলের ছন্দে সুরে / ছোটালেন তিনি গানের অজস্রতা / কাটা ছিল তাঁর টিকিট অনেক দূরে’ – কী সাংঘাতিক কাজ রে বাবা! এইটুকু জায়গার মধ্যে সলিলের ‘ধিতাং ধিতাং’ আর ‘এই রোকো’ দু দু খানা গানের উল্লেখ করে ফেললেন সরাসরি লিরিকের মধ্যেই। যেখানে আবার ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ এল সুরের উদ্ধৃতি সমেত। আরও যেটা সাংঘাতিক, নিজের তৈরি পরের কথা গুলোর সুরের ওপর দিয়েই কাউন্টার হিসেবে একটা ‘ব্রাস’ ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’র কনটিনিউয়েশনে বাজিয়ে দিলেন সলিলের তৈরি ‘কে মাদলে তান তোলে’র সুর। ব্যাস ওইটুকু। চমত্কার খাপও খেয়ে গেল সুরে! ঠাসা ইনফরমেশন। তৈরি হল শিল্পের আধুনিক ভাষা।
বন্ধুরা হয়ত ভাবছেন সলিলের কথা বলতে গিয়ে সলিলোত্তর সংগীতকারের কাজের প্রসঙ্গ কেন টেনে আনলাম। আনলাম; কেননা এই ট্রিটমেন্টের আকরটা ছিল সলিলের কাছেই। সুরের উদ্ধৃতি – অনেকটা সিনেমার ফ্রিজ শটের মত, একটা বিশেষ ট্রিটমেন্ট। মিনিংফুলি ব্যবহার করতে পারলে শিল্প, না হলে সেটা আর সিনেমা থাকবে না; স্লাইড শো হয়ে যাবে। এটা বাংলা গানে সলিলের অবদান। মনে করে দেখুন, ‘সেই মেয়ে’ গানে ‘হয়ত তাকে কৃষ্ণকলি বলে’ – এই ট্রিটমেন্টের একটি অমোঘ প্রয়োগ।
কী আশ্চর্য বলুনতো, সলিল উদ্ধৃত করলেন রবীন্দ্রনাথকে, সলিলকে উদ্ধৃত করলেন সুমন। এটাই আমাদের সংগীত সভ্যতা। সুরের উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে আর কোনও সংগীতকারের কোনও কাজ মনেই আসছে না। দু একটা বোধহয় আরও চেষ্টা হয়েছিল – যেমন কদিন আগে একটা বাংলা সিনেমার গানে রবীন্দ্রনাথের ‘মম চিত্তে’ গানটির অনুষঙ্গের কথা মনে পড়ছে; তবে সেটা ঠিক বিষয়ে থাকেনি, ফলে সেটা বা সেধরণের আরও কাজ গুলোকে ঠিক উদ্ধৃতি বলতে পারলাম না। এটা সকলের পারার মত বিষয় নয়।
সলিল চৌধুরী বাংলা গানে আর যেটা এনেছিলেন, সেটা হল বিষয়-বৈচিত্র্য। এটা বলতে গেলে বিশেষ ভাবতে হয় না, যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তাঁর আগে এতো বিষয়ে কেউ গান লেখেননি। সমাজের নানস্তরের মানুষের কথা নানা ভাবে সলিলের গানে উঠে এসেছে। তাঁর আগে পুরুষ শাসিত সমাজে মহিলাদের কষ্ট নিয়ে গান, ফেলে আসা জীবনকে সেলিব্রেট করার গান, অনাহার, মন্বন্তর নিয়ে গান, যুদ্ধবিরোধী গান বাঙালি সেভাবে ভাবতেও পারেনি। রাজনৈতিক ভাবে তাঁর অ্যাক্টিভিস্ট সত্ত্বা সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তাঁর গানের বিষয় এবং বক্তব্য একটা দিশা পেত – এসব কথা বহুচর্চিত। সব সত্যি, কিন্তু আমার বরাবর মনে হয়েছে আন্দোলনের দিনগুলো পেরিয়ে গেলে তাঁর মিউজিশিয়ান সত্ত্বা তাঁর গীতিকার সত্ত্বাকে সব সময় ডমিনেট করে এসেছে – আর দুয়ের মাঝখানে দোলাচলে থেকেছে তাঁর অ্যাক্টিভিস্ট সত্ত্বা।
একটু নির্লিপ্ত ভাবে যদি বিষয়টা দেখি; বাঙালি, গীতিকার হিসেবে তাঁকে যে আসনে বসিয়েছে সে হিসেবে আধুনিক গানে তাঁর রচনাশৈলী আমার একটু কাঁচা বলেই মনে হয়েছে। খোলা মনে বলতে গেলে সলিলের গান লেখার ব্যাপারটা আমার কাছে একটু ধূসর পাণ্ডুলিপির মত। কেননা সলিল লিখতে জানতেন না তা একেবারেই নয়। বরং অনেকের থেকে ভাল জানতেন। নাহলে ‘ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা গ্রামখানি কোন মায়া ভরে’র মত একটা ছবি কেউ খাতায় লিখতে পারে? কেউ ‘প্রান্তরের গান আমার’ লিখতে পারে?
‘কোনও গাছে কোনও কুঁড়িরা ফোটেনি / কোনও অঙ্কুর মাথাও তোলেনি / প্রজাপতি যত, আরও একদিন গুটিপোকা হয়ে ছিল – সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিল’ এ কেউ লিখতে পারে? কেউ লিখতে পারে – ‘সর্বভাষী মাংস পাবে সব দেশী পাঁঠা / পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা / তিনরঙ্গা খাঁড়া দিয়ে সব মাংস কাটা’র মত লাইন?
কী আশ্চর্য, এখনো এই মুহূর্তেও ভরা ভোটের বাজারে এই কবিতাটা মনে করতে গিয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে – কী প্রাসঙ্গিক! “আসুন! আসুন! কার তাজা মাংস চাই / হাতে যেন থাকে খাঁটি খদ্দরের থলি / ভীষণ সস্তা মাংস গঙ্গাজলে ধোয়া / রামধুন গেয়ে গেয়ে তবে বলি দেওয়া…”
তিনটি বিখ্যাত কবিতায় সুর করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন সলিল। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর ‘পালকির গান’ আর বিমলচন্দ্র ঘোষের কবিতা আংশিক নিয়ে ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’।
পায়রার গান নিয়ে আবারও কাটাছেঁড়া না করে আমরা যদি ‘রানার’ আর ‘পালকি’তেই একবার দেখতে চেষ্টা করি, কোন অংশটা সলিল সুরে বাদ দিয়েছেন, তাহলে বোধহয় একটা খবর পাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে –
‘রানার’ এর অরিজিনাল টেক্সট থেকে গানে বাদ গেছে – “শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ / ভীরুতা পিছনে ফেলে – / পৌঁছে দাও এ নতুন খবর, / অগ্রগতির ‘মেলে’, / দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি – / নেই, দেরি নেই আর, / ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে / দুর্দম, হে রানার”
গানটা তো এমনিতেই বিরাট বড়। চাইলে কি সলিল এই অংশটাকে রেখে সুর করতে পারতেন না? কিন্তু তা তিনি করলেন না। আমার ধারণা, তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, এই অংশ যা বলছে, গানটা ইতিমধ্যেই সেটা বলে ফেলেছে। গানে নতুন খবর দেবার কথা বলা থাকলেও এই অংশের টেক্সট আর কোনও নতুন খবর দিচ্ছে না – সলিল তাই সার্থক কমিউনিকেশনের স্বার্থে নির্মম ভাবে তাঁর টেক্সট কে এডিট করেছিলেন। ঠিক এইখানে তাঁর সংগীতবোধ চলচ্চিত্রের কছাকাছি।
পালকির গানে দেখবো তিনটে খেপে বাদ গেছে তিনটে স্তবক – “কাজলা সবুজ / কাজল পরে / পাটের জমি / ঝিমায় দূরে! / ধানের জমি / প্রায় সে ন্যাড়া, / মাঠের বাটে/ কাঁটার বেড়া!”, “টাটকা কাঁচা / শাল পাতাতে / উড়ছে ধোঁয়া / ফ্যান্সা ভাতে” আর “আর দূর কী গো? / বুড়ো শিবপুর / ওই আমাদের; / ওই হাটতলা, / ওরি পেছুখানে / ঘোষেদের গোলা।”
সলিল এটাও এডিট করলেন, কারণ আমার ধারণা এই অংশের ফোনেটিক্স নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। বাদ যাওয়া প্রথম চরণে ‘জমি’ কথাটা দুবার আসছে – যেটা লিরিক্যাল প্যাটার্ণে ধ্বনিগত ভাবে বেমানান। দ্বিতীয় অংশে “টাটকা কাঁচা শালপাতাতে” কথাটাও ধ্বনিগত ভাবে শুনতে ভাল না।
রবীন্দ্রনাথ ওরিজিনালি লিখেছিলেন – “শুষ্ক পাতায় সাজাই তরণী একা একা করি খেলা”। কে করেছিলেন মনে নেই, (পঙ্কজকুমার মল্লিক কি? হতেও পারেন) প্রথম রেকর্ড করার সময় তাঁর পার্মিশন নিতে এসে গেয়ে শুনিয়েছিলেন গানটি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – ‘ওপেনিং ওয়ার্ডে ‘শুষ্ক’ কথাটা কানে লাগছে, ওটাকে ‘ছিন্ন’ করে দিও’। ওটা পারমানেণ্টলি ‘ছিন্ন পাতায় সাজাই তরণী’ হয়ে গেল।
কেন কানে লাগছিল রবীন্দ্রনাথের? ঠিক যে কারণে সলিলকে ‘কাঁচা শালপাতাতে’ কাঁচি চালাতে হয়েছিল।
‘পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভোতল কই গো কই মেঘ উদয় হও’-এর কবি সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন ছন্দের জাদুকর। কিন্তু জাদুকরও তো মানুষ! পালকির গানের শেষ যে চরণটি বাদ দিয়েছিলেন সলিল, তাতে চলে এসেছিল বাড়তি মাত্রা। ‘আর দূর কী গো?’, ‘বুড়ো শিবপুর’, ‘ওই হাটতলা’, ‘ওরি পেছুখানে’, ‘ঘোষেদের গোলা’ এই সব কথাগুলোতে বেশি মাত্রা আছে। যার ফলে মিটারে মিলছে না। এটাই বাদ দেবার সবচাইতে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ বলে আমার মনে হয়। আর তা ছাড়াও; গোটা গানের ভাষা ছিল বর্ণনামূলক। এখানটাতে এসে সেটা হঠাত্ সংলাপ হয়ে উঠল। যেটা বেখাপ্পা।
বাদ দেওয়া অংশটা স্টাডি করে আমার ইনটারেস্টিং লাগছে এইজন্যে যে ‘লিরিকের সংগীতিক সম্ভাবনা’ ব্যাপারটা সলিল কিরকম বুঝতেন ও গুরুত্ব দিতেন, সেটার একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু সাহিত্যে এমন পারদর্শী সলিল সম্পর্কে অমন কথা তাহলে কেন লিখলাম, যে বাঙালি, গীতিকার হিসেবে তাঁকে যে আসনে বসিয়েছে সে হিসেবে আধুনিক গানে তাঁর রচনাশৈলী আমার একটু কাঁচা বলেই মনে হয়েছে?
হয়েছে কারণ আমি রবীন্দ্রনাথ শুনেছি। আমি কবীর সুমনকে শুনে ফেলেছি। ‘যা গেছে তা যাক’ এর অ্যাপ্রোচের অনিবার্যতা স্বীকার করে নিয়েও বলছি – ‘দূর নয় বেশি দূর ওই সাজানো সাজানো বকুল বনের ধারে / ওই বাঁধানো ঘাটের পাড়ে / যেথা অবহেলা সয়ে সয়ে কিছু ফুল শুকানো শুকানো হয়ে / পড়ে পড়ে আছে তার কিছু দূরে ঘাটের চাতাল ছাড়িয়ে’ – মাই গড! সেনটেনসের গঠনই এত কাঁচা, ভাল লিরিক বলব কি করে একে? সাজানো সাজানো, সয়ে সয়ে, শুকানো শুকানো, পড়ে পড়ে – বোঝা যাচ্ছে তাঁর সময়ে মাইক্রোসফ্ট ওয়ার্ড ছিল না। নাহলে লেখার নিচে লাল কিলিবিলি লাইন কেটে বলত ‘ডিলিট রিপিটেড ওয়ার্ডস’!
তাঁর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ, যে তিনি আধুনিক গানে ‘ধ্বনিকে’ সিরিয়াসলি নিলেও লিরিককে ততটা সিরিয়াসলি নেননি। নাহলে “সুরেরো ঝর ঝর ঝর ঝর্ণা / ঝর্ণা হায় মরি হায় মরি হায় রে ঝরোণা ঝরে রে / সুরেরি এই গুণ গুণ গুঞ্জন / গুণ গুঞ্জন হায় চলে যায় চলে রে রহে না ঘরে রে” তারপর অন্তরাতে “লোটন লোটন পায়রা গুলি প্যাখোম মেলেছে” ইত্যাদি ইত্যাদি। মিউজিক্যালি ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু আই অ্যাম সরি, দিস ইস নো সিরিয়াস সং রাইটিং! এরকম এতো উদাহরণ, যে দিয়ে শেষ করতে পারব না। উফফ – “মোর মন বৈরাগী শিশুর মতন / কেন জানিনা” – তা সত্যিই জানি না!
কিন্তু তার পরেও জানেন, দিনের শেষে আমি পাজলড হয়ে যাই। যখন শুনি “হায় কোথায় শ্যামল মাটির মায়া / হায় কোথায় সবুজ বনের ছায়া / কোথা সে নীড়, গভীর প্রেমের মোহানা – আহা কোথায় সে তীর?”
কান্না পেয়ে যায়। কেন লিখল না লোকটা? কেন? কেন? কেন?
* * *
বন্ধুরা, যাঁরা আমার এই লেখা পড়লেন এতক্ষণ ধৈর্য ধরে; নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, আমি তাঁর সুর, সুরের গঠনগত বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত কোনও আলোচনায় যাবার ধৃষ্টতা দেখাইনি। কেননা সে যোগ্যতাই আমার নেই।
আমি শুধু আপনাদের সঙ্গে তাঁর সংগীতের ভাষা, ছন্দবৈচিত্র্য, তাঁর সাহিত্যবোধ আর তাঁর লিরিকের সাহিত্যমূল্য সংক্রান্ত আমার কিছু বিস্ময়, অনুভব আর স্বগতোক্তি ভাগ করে নিতে চাইলাম। ভাগ করে নিতে চাইলাম আমার পথ হারানো পথের গল্প। তাঁর কাজ আমাকে কী বার্তা দেয়, তারই খানিকটা শেয়ার করলাম বলতে পারেন। এ লেখার প্রতিপাদ্য কিছু নেই। আমার কিছু বলাতে সলিলের কিছু এসে যাবে না – আমি আগামী কুড়ি জন্ম ধরে তাঁর কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরে দূরেই ঘুরে যাব।
সলিল চৌধুরীর মত একজন জিনিয়াস সংগীতস্রষ্টাকে নিয়ে লেখার যে কী বিপদ, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আর মনে মনে সম্পাদক মশাইয়ের ছবিটা ভেবে বিড়বিড় করছি। তাঁতি মানুষ, দিব্যি তাঁত বুনে খাচ্ছিলাম, আমাকে দিয়ে এঁড়ে কেনানোর খুব দরকার ছিল? খুউউব?
—————————–
১৫ মে, ২০১৪। বৃহস্পতিবার।
দমদম ক্যান্টনমেন্ট
পুনশ্চ: সলিল নিয়ে আমার এই সলিলকি লেখা হয়েছিল ‘লেখালেখি’ পত্রিকার জন্যে এবং সম্পাদক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর তাগিদে। তাঁর অনুমতিক্রমে এই ওয়েবসাইটেও রচনাটির সংযুক্তি ঘটালাম। – ৪ জুলাই, ২০১৫