পথভোলা

এখন বর্ষা। আজ থেকে অনেকদিন আগে, সেই ২০১২ সালে বোধহয়, সেবারও বর্ষাতেই একবার রেকর্ড করেছিলুম এই গানখানা। আসলে ঠিক কী কারণে যে তখন পেয়ে বসেছিল এই গানটা – সেটা বুঝিনি, তড়িঘড়ি রেকর্ড করে ফেলার যে গভীর ডাক এসেছিল, তাকে অস্বীকার করতে পারিনি। ধর্মতলার সিম্ফনির দোকান থেকে কেনা একটা সিডিতে সেই ট্র্যাকটা পেয়েছিলুম। খুব যে আহামরি কিছু ট্র্যাক তাও নয়, রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে গতানুগতিক যেরকম যন্ত্রানুসঙ্গ বাজে, তাইই। তবু বাজিয়েছিলুম সেটার ওপরেই। কেননা গানটা বাজানোর তাগিদটাই ছিল সেই মুহূর্তে সত্যি। তার থেকে বেশি সত্যি আর কিছু ছিল না।

সচরাচর যেমন করি, সেভাবেই ইউটিউবে দিয়ে দিয়েছিলুম সে গান। রেখেছিলুম আমার ওয়েবসাইটেও। বেশ কিছু মানুষ যখন শুনতে শুরু করে দিয়েছেন, সেই ট্র্যাকের মালিকদের তখন টনক নড়ল। কপিরাইট ক্লেম করে ইউটিউব থেকে মহামান্যরা হাওয়া করে দিলেন আমার বাজনা। পরে আরও একবার এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। অন্যের ট্র্যাকের কারণে আমার ট্র্যাক রেকর্ড খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে। আর যাই হোক, নিজের মনে গান বাজনা করে শেষে চোর বদনাম কিনতে আমি রাজি নই। তাও যদি নিজে যন্ত্রানুসঙ্গ রচনা করতে না পারতুম তো একটা কথা ছিল। এসব কারণেই অন্যের তৈরী ট্র্যাকে গান রেকর্ড করা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। এর ফলে কাজের সংখ্যা গেছে কমে। নিজের জন্য যন্ত্রানুসঙ্গ নিজেই রচনা করি। আমার ধারণা, মন্দ করি না। ওটা আমি পারি।

ইউটিউব আমার গান হাওয়া করে দেবার পরেই ভেবে রেখেছিলুম এই গানটা আবারও রেকর্ড করতে হবে এবং নিজের যন্ত্রানুষঙ্গেই করতে হবে। সেই মত একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করে রেখে দিয়েছিলুম। কিন্তু রেকর্ড আর করা হয়নি। যদিও অ্যারেঞ্জমেন্টটা বেশ মনের মত হয়েছিল।

কয়েকদিন আগে স্বনামধন্য ঘট্টম শিল্পী সোমনাথ রায়ের সঙ্গে গানবাজনা সংক্রান্ত একটা পেশাদারী কাজের সূত্রে আমার কথা হচ্ছিল। কথার ফাঁকে তিনি যৌথ ভাবে নিজেদের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। তিনি আমাকে বলেন একটা রবীন্দ্রনাথের গানের যন্ত্রানুসঙ্গ রচনা করতে, যার রিদমটা তিনি করে দেবেন। কাজের কথার ফাঁকে নেহাতই একটা কথার কথা, কিন্তু তিনি আমার মাথায় একটা ভাবনা পুরে দিলেন।

পরে সেই ভাবনাই আমায় মনে করিয়ে দিয়েছিল এই গানটার কথা, যার অ্যারেঞ্জমেন্টটা মোটের ওপর করাই ছিল। তখন কিউবেসে কাজ করতুম। এখন লজিকে করি – ধ্বনির দিক থেকে লজিক আরও চমৎকার। পুরোনো অ্যারেঞ্জমেন্টটা লজিকে নিয়ে এসে আরও দু একটা যন্ত্র জুড়ে দিলুম। বাদও দিলুম গোটা দুয়েক ট্র্যাক। তারপর পাঠিয়ে দিলুম সোমনাথদাকে। নিজের বাড়িতেই তিনি সেটার ওপরে কাহন, খোল আর মঞ্জীরা বাজিয়ে রেকর্ড করে আমাকে পাঠালেন। ইতিমধ্যে আমি আমার বাড়িতে হারমোনিকা আর মেলোডিকাতে গানটা রেকর্ড করে ফেলেছি।

আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি – গানটার একটা বিশেষত্ব হচ্ছে এর প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গি। কথোপকথনের ঢঙে এগিয়ে চলা এরকম গানের অভাব তো দুনিয়ায় নেই; এই মুহূর্তে মনে পড়ছে বেশ কয়েকটা – হ্যারী বেলাফণ্টের গাওয়া মজার গান ‘There’s a hole in the bucket’, পিট সীগারের বিখ্যাত ‘Where have all the flowers gone’ কিম্বা What did you learn in school today’ অথবা বব ডিলানের ‘Where have you been my blue eyed son’ মায় আমাদের উত্তম-সুচিত্রা-মোটরবাইক – ‘পথ এখনো শেষ হল না’!

রবীন্দ্রনাথের এই গানটা সব সময় ডুয়েট গাওয়া হয়। একজন প্রশ্ন করেন আর আরেকজন উত্তর দেন। আমিও অমনি আমার মেলোডিকাটাকে আরও একবার ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে গেলুম। ওকে লাগালুম উত্তর দেওয়ার কাজে; আর প্রশ্নগুলো করালুম আমার হারমোনিকাকে দিয়ে। আর তাছাড়া – ‘কাঁদন ভরা হাসি’ যে কেবল হারমোনিকাই হাসতে পারে সে ব্যপারে আমার কোনও সন্দেহ ছিল না…

প্রশ্ন আর উত্তর যখন, বোঝাই যাচ্ছে এ গানে সুরের পাশাপাশি কথাগুলোর গুরুত্বও অপরিসীম। বিশেষত গানটা জানেন এমন মানুষ (যাঁরা সংখ্যায় নেহাত কম নন) যখন আমার বাজনা শুনবেন, কথা গুলো যদি স্পষ্ট করে বুঝতে না পারেন, অস্বস্তিতে পড়বেন। আমি তাই চাইলুম, আমার যন্ত্র দুটো কে দিয়ে কথা বলাতে। শব্দগুলো দাঁড়ি কমা সেমিকোলন জিজ্ঞাসা চিহ্ন সমেত উচ্চারণ করাতে চাইলুম। এই চেষ্টাটা সব সময়েই আমার থাকে, এই রেকর্ডিংএর সময় এ দিকটাতে বিশেষ ভাবে খেয়াল রেখেছিলুম।

আমাদের কাজ হয়ে গেলে শুরু হল ধ্বনিমিশ্রনের কাজ। তাঁর দ্য সাউন্ড ষ্টুডিওতে যে কাজ করলেন বন্ধু প্রতীক প্রধান। এই কাজটা করতে গিয়ে কতবার যে আমরা ওঁর ষ্টুডিওতে বসেছি তার শেষ নেই। আমার আর প্রতীকের কারুরই মনের মত হচ্ছে না, কাজেই প্রবল ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে আবারও বসার সংকল্প। আর এসমস্ত কাজ হচ্ছে আমাদের রুটিরুজিগত আর সব কাজ সেরে। অবশেষে মুচকি হাসি দেখা দিল দুজনেরই মুখে। দুজনেই প্রবল খুঁতখুঁতেমি নিয়ে কাজ করি বলে প্রতীকের সাথে কাজ করে খুব আনন্দ পাই।

এসব কাজের পরে মাথায় এলো মোটামুটি ভাবে দেখার যোগ্য একটা ভিডিও বানানোর কথা। ফলতার লাগোয়া শ্যামসুন্দরপুরে এর হারমোনিকা অংশের ছবি তুলে দিলেন শুভদীপ ডান। একদিনের জন্যে গেছিলুম সেখানে। ভেবেছিলুম মেলোডিকা অংশটির ছবিও সেখানেই তুলে রাখব। কিন্তু বেমালুম ভুলে গেলুম মেলোডিকা যন্ত্রটিকেই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। যে কারণে পরে আন্দুলের কাছে ক্ষেত্রপালতলায় কিছুটা, আর পাকুড়তলায় কিছুটা ভিডিও তুলে মোটামুটি ভাবে ভিডিও শুটিংয়ের কাজ শেষ করতে হয়েছিল। এই অংশের ছবি তুলেছিলেন পল্লব সরকার।

বর্ষা দেখছি রবীন্দ্রনাথের তৈরি এই বসন্তের গানখানার পিছু ছাড়বে না। ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে কী করে যে দ্বিতীয় আর তৃতীয় দিনের শুটিংয়ের কাজ শেষ করতে পেরেছি আমার সঙ্গীরাই কেবল জানেন।

* * *

অনেকদিন আগে একটা গান লিখেছিলাম:

“নীলের ভেতরে থাক
সীমাহীনতার ডাক
পথের ভেতরে থাক
অনন্ত
এই সময়ের মুখ
যে আসেনি সে আসুক
ঝরা শীতে ভরা থাক
বসন্ত”

শীতে না হোক বর্ষায় যে বসন্ত ভরা থাকলো, তা তো দেখতেই পাচ্ছি!

৮ জুলাই, ২০১৯
সোমবার
দমদম ক্যান্টনমেন্ট

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

  • Blog Stats

    • 19,879 hits
  • Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

    Join 22 other subscribers
%d bloggers like this: