মরি হায় গো হায় [Mori haay go haay]

মনে হচ্ছে আমার নতুন রেকর্ডিং সিস্টেম আমার কাজ অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। সেই যে প্রথম দিন, সন্ধেবেলা যন্ত্রটা কিনে এনে আর থাকতে না পেরে পরের দিনই রবিঠাকুরের ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’ রেকর্ড করে ফেললাম (বন্ধুর পরামর্শে আপলোডও করেছিলাম সেটা), সেটা বাজাতে বাজাতেই বোধহয় এই গানটা মাথার ভেতরে গুনগুন করতে করতে ভোমরার মত ঘুরপাক খেতে শুরু করেছিল।

এই গানটা, মানে ‘মরি হায় গো হায়’; ছেলেবেলা থেকে শোনা সলিল চৌধুরীর কথায়-সুরে শ্রীমতি সবিতা চৌধুরীর গাওয়া অসম্ভব সুন্দর একটা আধুনিক বাংলা গান।

কেন জানি না যখনই আমি এই গানটা শুনেছি, এর সুরের মার্কামারা সলিল-সুলভ যাতায়াতের পথে পথে আমার খালি রবীন্দ্রনাথের সুরে ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’ মনে পড়ে গিয়েছে। একদিন কোথাও একটা হারমোনিয়াম পেয়ে কষে বাজানোর চেষ্টা করছিলাম, দেখি ও মা! এই ভদ্রলোক তো রবিঠাকুরের সুরখানাকে প্রায় পুনরাবিষ্কার করে ফেলেছেন!! সুরের phrase ধরে ধরে তুলে এনেছেন, আগেরটা পরে বসিয়েছেন, কেটে ছেঁটে জুড়ে বেঁধে ওস্তাদ আমার শেষ রাত্রির খেলা খেলেছেন। এই দেখছি প্রায় স্বর ধরে ধরে রবীন্দ্রনাথের পাশে পাশে চলছেন, পরের মুহূর্তেই দেখছি একই স্বরসমষ্ঠী কে দুটো phrase এ ভেঙে নিজের ধাঁচে সাজিয়ে নিচ্ছেন। সুরটা যখন শেষ হচ্ছে, সম্পূর্ণ ভাবে সেটা সলিল চৌধুরীর সুর হয়ে দাঁড়াচ্ছে!

আমি অবাক হয়ে শুনছি:

গ – গ – | গ – ম – | প – ন – | র্স – ধ – | হ্ম – প – | – – – – পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে চলেছে… চলতে চলতে আগল ভেঙে কখন কিভাবে যেন – – গ র | ন্ স – গ | – প ন র্স ধ | হ্ম – – – | প – – – হয়ে উঠে নিবু নিবু সুরভী দীপের সলতের আগুনটুকু উস্কে দিচ্ছে। পরক্ষনে দুজনেই কড়ি মধ্যমে ল্যান্ড করছে! এক দিকে সুরের সুরধুনী বয়ে চলেছে, আর অন্যদিকে অনন্য জন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ছিন্ন পালে ভাঙা হালে তরী বেয়ে চলেছে। দুজনেই কিন্তু এবার ঘরে ফিরবে, যে যার আস্থায়ীতে। যে ঘরের দেওয়ালে কান পাতলে লুকোনো ইমন বাজে…

দুটো গানের যে দুটো লাইন এর নোটেশন দিলাম, তাতে স্বরগুলো পরপর যে একই সে তো দেখাই যাচ্ছে; ভাববার কথা হচ্ছে, শুধুমাত্র স্বরহীন মাত্রাগুলো দুই কম্পোজারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটা কেমন ধরেছে!!! স্থিতপ্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ সবকটা স্বরে সমান সময় দিচ্ছেন, আর সলিলের মাত্রা ভাগে ধরা পড়ছে স্বভাব-চঞ্চলতা। আমি একলা ঘরে হারমোনিয়ামের চাবি টিপছি আর আমার বাংলা গানের জন্যে বুক ফুলে উঠছে। শুধু এই একটা কারণে মনে হচ্ছে ‘ভাগ্যিস বাঙালি হয়ে জন্মেছিলাম!’।

সুখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথ বা সলিল চৌধুরী – দুজনের কেউই বাঙালি ছিলেন না। আমি দেখছি দুই জাত কম্পোজার একে অন্যের সাথে লুকোচুরি খেলছেন। সময়ের ওপারে দুজনে দুটো গান কে খেলিয়ে দিচ্ছেন সৃষ্টিশীলতার অনাবিল আনন্দে।

“ধরো দেখি ধরতে কী পারবে আমায়?” (না, ‘টাচ মী ইফ ইউ ক্যান’ এর ঢঙে নয় ঠিক) – সলিল খেলে বেড়াচ্ছেন শিশুসুলভ সরল্যে। ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রমাণ রেখে যাচ্ছেন, এমন কী শব্দে-সুরে উদ্ধৃত করে ফেলছেন রবীন্দ্রনাথকে। একই সুরের উপরে দাঁড়িয়ে ‘চৌদিকে’ শব্দটিকে সচেতন ভাবে রাখছেন গানের শরীরে। যেন সম্মান জানাচ্ছেন পূর্বজকে… স্পিরিট!

এবারে, এমনটা কিন্তু নয় যে এইসব সাত-পাঁচ ভেবে-টেবে আমি পরপর এই দুটো গান রেকর্ড করে ফেললাম। এ তো আমার ছেলেবেলার ভাললাগা, কিন্তু কখনো সেভাবে হারমোনিকায় বাজিয়ে দেখিনি। এ কথা ঠিক, ‘তুমি কেমন করে’ রেকর্ড করার পরে এ গানটা আবার আমার মাথায় ঘুরঘুর করেছিল, তবে বাজাবো বলে ভাবিনি। গানটার সাথে সাথে এইসব কথাগুলোকেও মাথার ভেতরে সাত-সতেরো আরও অনেক কিছুর আড়ালে রেখে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো।

মনে হচ্ছে গত নভেম্বরেই হবে, আপিস থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়েছিল সেদিন। ক্লান্ত। টিভির ঘরে ঢুকে চালিয়ে দিয়েছিলাম যন্ত্রটা। কলকাতা দূরদর্শনের আর্কাইভ থেকে একটা পুরোনো অনুষ্ঠান আবারও সম্প্রচারিত হচ্ছিল। যেটা দেখে পোশাক-টোশাক না বদলেই আমি যথারীতি জমে গিয়েছিলাম টিভির সামনে। সলিল চৌধুরীর কথায়-সুরে শ্রীমতি সবিতা চৌধুরী আধুনিক বাংলা গান গাইছিলেন। হাতে একটা ভায়োলিন নিয়ে অর্কেস্ট্রা কনডাক্ট করছিলেন শ্রী দেবজ্যোতি মিশ্র। কী-বোর্ডস বাজাচ্ছিলেন শ্রী তাপস ভৌমিক (যাঁকে আমরা পিয়ানো একর্ডিয়ান হাতে দেখতেই বেশি অভ্যস্ত) এবং শ্রীমতি অন্তরা চৌধুরী। যদ্দুর মনে আসছে, শ্রী রাহুল চ্যাটার্জী কেও যেন দেখছিলাম সেতার হাতে…

আরও কয়েকটা গানের সঙ্গে ‘মরি হায় গো হায়’ ও গেয়েছিলেন সেদিন সবিতা চৌধুরী। অনুষ্ঠান শেষ হল আর আমি সটান আমার হারমোনিকা বের করে গানটা বাজাতে শুরু করলাম। সেই মুহূর্তেই গানটা রেকর্ড করার কথা প্রথমবার আমার মাথায় এসেছিল।

আমার কাছে এই গানটার কোনও মিউজিক ট্র্যাক ছিলনা। ফলে ঠিক করলাম, ‘তুমি কেমন করে গান করো’র মত গিটার বাজিয়েই রেকর্ড করব। আর ততদিনে আমার আরেকটা পুরনো গিটার হাসপাতাল থেকে ফিরেছে, গায়ে তার আবার একটা নতুন পিক-আপ লাগানো হয়েছে, সেটাও টেস্ট করে নেওয়া যাবে একই সঙ্গে।

যখন আমি নোটেশন লিখছি, তখন আমার মাথায় আরও ইমপ্রভাইস করার আইডিয়া আসতে শুরু করল। আমার মাথার মধ্যে যে শব্দ-কল্পদ্রুম তৈরি হচ্ছিল, ঠিক করলাম হারমোনিকাকে সেখানে একাধিক ভূমিকায় রাখব… লিড তো করছেই, হারমোনিকা দিয়েই ইন্টারল্যুড, কাউন্টার হার্মনি আর ওব্লিগাটো বাজাব। নানান স্টাইলে বাজিয়ে, ফুঁ এর তারতম্যে একই ইন্সট্রুমেন্টকে দিয়ে আলাদা আলাদা রকম উচ্চারণ করানোর একটা চেষ্টা করব। দুটো ভায়োলিন, একটা ভিয়োলা আর একটা চেলো নিয়ে যদি একটা স্ট্রিং কোয়ার্টেট হতে পারে, তাহলে চার এক্কে চারটে হারমোনিকাই বা কী দোষ করল? সেইমত চারটে ট্র্যাক এ হারমোনিকা নিলাম চার রকম ভাবে। আমার সাধ্য-মত গিটার বাজানোর চেষ্টা করলাম গানটার শরীর জুড়ে। এখানে বলে রাখা ভাল, আমি মোটেও একজন প্রশিক্ষিত গিটার বাজিয়ে নই। তার ওপরে অনেক কালের অনভ্যাসের আড় ভেঙে সারা গানটার গিটারের অনুষঙ্গগুলো মোটামুটি ভাবে ঠিক সুরে বাজাতেই আমার গোটা একটা দিন লেগে গেল! দুটো ট্র্যাকএ রিদম গিটার নিলাম, আর তার মধ্যে একটাতে প্লেকট্রাম ব্যবহার না করে আঙুল দিয়ে বাজালাম, যাতে দুটো গিটারের শব্দের মেজাজ দুরকমের হয়। গিটারে কিছু কাউন্টার-মেলোডি বাজানোর চেষ্টাও করলাম। দু দুটো ট্র্যাক খরচ করলাম তার জন্যে। আরও একটা ট্র্যাকে (গিটারের শব্দটাকে স্যাম্পলড শব্দ দিয়ে বদলে নিয়ে) আমি bass নোটগুলো বাজালাম অনেকটা ‘ডাবল বেস’ এর কায়দায়। আগেকার অর্কেস্ট্রাগুলো তে কী যে সুন্দর করে ডাবল বেস বাজতো…

জানতাম, সলিল চৌধুরীর অর্কেষ্ট্রেশন নকল করার যোগ্যতাও আমার নেই। তাই ওপথে আদপেই না হেঁটে সলিলের পথের আভাসটুকু রেখে নিজেই গড়ে পিটে নিলাম সুরগুলোকে। নোটেশন লিখে যখন সমস্ত গানটাতে কোথায় কী বাজবে পুরোটা ছকে নিচ্ছি, দেখলাম একটা বাড়তি ওব্লিগাটো জুড়ে দিয়েছি; যার ইঙ্গিতটুকুও সলিল করেননি। বাড়াবাড়ি করার ইচ্ছে, স্পর্ধা বা সাধ্য কোনটাই ছিল না, কিন্তু এটাকে ফেলতে পারলাম না, রেখেই দিলাম শেষ পর্যন্ত।

এইভাবে একটা হারমোনিকা আর একটা গিটারকে সম্বল করে রেকর্ড করে ফেললাম গোটা গানটা।

জানিনা শুনতে এটা কিরকম দাঁড়িয়েছে, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, পুরো কাজটা একা হাতে (এবং মাথায়) করার সময় যে শান্তি আর আনন্দ পেয়েছি… হলফ করে বলতে পারি, সেই মুহূর্তে দুনিয়ায় আর কোত্থাও, অন্য কিচ্ছু আমাকে তা দিতে পারতো না…

ভিডিওটা বানানোর সময়ও কিছুটা মজা করলাম। ভিডিওর শট গুলো ভাবতে ভাবতে মনে হল, ঠিক যে ভাবে গানটা আমার ভাবনায় আসে, সলিলবাবু আর রবীন্দ্রনাথের দুটো সুর একে অন্যের সাথে কথা বলছে, খেলছে, interact করছে; আমি ছবিতে যদি তাই দেখাই? এক্ষেত্রে interaction টা ঘটবে আমার সেলফ এর মধ্যে। আমিতে-আমিতে সুরের ইশারায় কথা হবে, কেন না আমি নিজেই নিজেকে সঙ্গত করছি… এক্কেবারে যাকে বলে ‘নিজের মর্ম নিজেই বোঝা’ – আমিও ‘মর্মটা তার তালেই নচিয়ে’ দিলাম। গোটা গানটার শট ডিভিশনের ছক আঁকা হয়ে রইল আমার মাথার মধ্যে। সেই মত শুট করতে সময় লেগেছিল খুব বেশি হলে ঘণ্টা দেড়েক।

প্রায় মাস দেড়েক আগে এই কাজটা করেছিলাম, দুজন মিউজিশিয়ান বন্ধুর সাথে শেয়ারও করেছিলাম, কিন্তু সময়ের অভাবে আপলোড করা হয়ে ওঠেনি।

আরেকটা মজার কথা, নিজের লেখা অনুবাদ করা এই প্রথম। এই ভূমিকাটা আমি প্রথমে লিখি ইংরিজিতে, যা আমি ইউটিউব এবং ফেসবুক এ শেয়ার করেছিলাম। এখন আমার নিজস্ব ওয়েবসাইট এ দেব বলে বাংলায় অনুবাদ করার সময় বেশ কিছুটা গায়ে-গতরে বাড়িয়ে নিলাম।

তার চেয়েও জরুরী কথা হল; বন্ধুরা, আপনাদের মধ্যে যদি কেউ আসল গানটা এখনো না শুনে থাকেন, প্লীজ ইন্টারনেটএ সার্চ করে দেখুন আর শুনে নিন। আমি যেটুকু করতে পেরেছি, সেটা কিচ্ছু না, সে শুধু আমার প্রাণের আরামে। সলিলবাবু আর সবিতা দেবীর করা কাজটা শোনা খুব জরুরী। সে একটা অভিজ্ঞতা।

২৬ জানুয়ারী ২০১২, বৃহস্পতিবার
দমদম ক্যান্টনমেন্ট

Comments
6 Responses to “মরি হায় গো হায় [Mori haay go haay]”
  1. notes.salilda.com says:

    সুমন্ত, তোমার প্রচেষ্টা অসাধারণ এবং অভিনব আর তোমার হারমনিকা ও গিটার শুনে মুগ্ধ হলাম I আমার আন্তরিক অভিননন্দন যেন I
    তোমার লেখাটা না থাকলে জিনিসটা একটু অসম্পূর্ণ রয়ে যেত I তোমার বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পেতাম না I
    আরো শোনার জন্যে ব্যাকুল রইলাম I
    গৌতমদা

    • Sumanta Basu says:

      গৌতমদা,
      আপনি যে এটা শুনেছেন আর আমার পাগলামির বর্ণমালায় চোখ রেখেছেন, এটা জেনে খুবই ভাল লাগছে। পাশাপাশি আমার গিটারের কথা উল্লেখ করেছেন বলে লজ্জাও করছে খুব। গিটারে আমি নেহাতই আনাড়ি, আর সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝি!

      তবে খুব উত্সাহ পেলাম। প্রণাম নেবেন।

      সুমন্ত।

      • fmajor7blog says:

        সুমন্ত,
        এই যদি তোমার বর্ণমালা হয় তাহলে তোমার কবিতার জন্য অধীর অপেক্ষায় রইলাম I
        সলিলদার গানের সাথে যে গিটার বাজায় তাকে আমি ঠিক আনাড়ি বলতে পারছি না I
        এর পরের বার যখন দেশে এসব তখন ভাবছি আমার কর্ড হারমনিকা টা নিয়ে আসব – বেশ একসাথে রেকর্ড করা যাবে I
        “আজ নয় গুন গুন” গানটা প্রাকটিস করতে শুরু কর.I original গানটা C# মাইনরে I অবশ্য অন্য স্কেলেও বাজাতে পারো I দারুন কর্ডস আছে I
        ভালো থেকো I
        গৌতমদা

      • Sumanta Basu says:

        খুব ভাল লাগবে একসাথে কাজ করতে পারলে। আমি অপেক্ষায় থাকবো!

  2. Subhamay Ray says:

    অসাধারণ। বারবার শুনছি। গানবাজনার কিছুই জানি না এই আক্ষেপ আপনার এই রেকর্ডিংটা আরও উসকে দিল। ভালো থাকুন, বহুদিন বেঁচে থাকুন, এইভাবে আমাদের আরও সমৃদ্ধ করুন।

    • Sumanta Basu says:

      আমিও কিছুই জানিনা দাদা… প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত শেখার চেষ্টা করে চলেছি। বিশেষ কিছুই শিখে উঠতে পারিনি। আমার কাজে আগ্রহ প্রকাশের জন্যে বিশেষভাবে ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

  • Blog Stats

    • 19,774 hits
  • Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

    Join 22 other subscribers
%d bloggers like this: