রোদনভরা বসন্ত

সেটা ছিল এপ্রিলের মাঝামাঝি। বাতাসে তখনও বসন্ত থেকে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটা বসন্তের গান মাথায় ঘুরছিল, তার মধ্যে এই গানটা রেকর্ড করব ব’লে ঠিক করেছিলাম। আসলে হয়ত এটা একটা পার্টিসিপেশনের জায়গা থেকে। কলকাতার অলিতে-গলিতে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া বসন্তের নাগরিক গন্ধটার সাথে একাত্ম হতে চাওয়ার একটা জায়গা থেকে। সুর-হীন একটা সময়ে এই ধরণের অকারণ, অহৈতুকী চাওয়াগুলোকে লিখে বা ব’লে বোঝানো শিশি-বোতলের থেকে কিছু কম শক্ত নয়।

আসলে, হারমোনিকা যন্ত্রটা বাজাতে চেষ্টা করলেও সে অর্থে আমি হারমোনিকা প্লেয়ার নই। মানে, একজন সিরিয়াস যন্ত্রশিল্পীর ভাবনা যে রকম ‘যন্ত্র-সর্বস্ব’ হ’লে তিনি স্কিল-চূড়ামণি হয়ে উঠতে পারেন, সেরকম তো নই-ই। ভেবে দেখেছি বাংলা গানকে ভীষণ রকম ভালবাসা ছোট খাটো মাপের একটা মিউজিশিয়ান ছাড়া আমি আসলে আর কিছুই না। অসম্ভব ইচ্ছে করে গান গাইতে; কিন্তু কন্ঠ সাধে বাধ। কাজেই ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে শেখা ক্রোম্যাটিক হারমোনিকা হয়ে ওঠে আমার ইচ্ছে পূরণের একমাত্র মাধ্যম। তাই গান সংক্রান্ত আমার ভাবনাগুলোর সচেতন প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করি এই ইনস্ট্রুমেন্টাল পিস গুলো রেকর্ড করার ভেতর দিয়েই।

ভেবে দেখেছি, একটা গান নিয়ে আমার ভাবনা গুলো ঠিক একজন যন্ত্রশিল্পীর মত ক’রে আসে না। বাজানোর অনেক আগে থেকেই একটা গান আমার মাথার ভেতর হয়ে উঠতে থাকে। তার কথাগুলোকে নিয়ে, সুর-টাকে নিয়ে, গায়কী নিয়ে, যন্ত্রগুলোকে নিয়ে – গোটাগুটি একটা সাউন্ডস্কেপ তৈরী হতে থাকে মাথার ভেতর। আমি কী যন্ত্র বাজাবো, সেই ভাবনাটা আলাদা করে আসে না।

যাক গে। সেসব বড় কথা নয়। কথা হচ্ছিল বসন্ত নিয়ে – এই কাজটা সে সময়কারই। এই যে এই গানটা রেকর্ড ক’রে ফেলে রেখে দিয়েছিলাম অসমাপ্ত ভাবে, তার অনেক গুলো কারণের ভেতরে দুটো কারণের কথা বলব।

এক – অন্য কাজে; বেশ কিছু নতুন বাংলা গানের যন্ত্রানুষঙ্গ রচনার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছিলাম। সেগুলো রেকর্ডিংয়ের কাজ চলছে। খুব শিগগিরই হয়ত সেগুলো শোনাতে পারব। আমার লেখা কথায় সুর ক’রে গানগুলি গাইছেন আমার বন্ধু অভ্র ঘোষ। (সেই ছিয়ানব্বই সালের শেষ থেকে বোধ হয়, আমরা দুজনে গান তৈরী করে চলেছি। শ’পাঁচেকের মত গান তো বানিয়েইছি অ্যাদ্দিনেতার কত গান যে ফেলে দিয়েছি, হারিয়ে ফেলেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অথচ আমাদের তৈরী করা কোনও গান প্রকাশ্যে সে ভাবে কখনও আনিনি। আমরা এরকমই। আগে তাও অনুষ্ঠান করতাম, আজকাল সেটাও করি না আজকাল বয়েস বাড়ছে আর মনে হচ্ছে কিছু কাজ শোনানো দরকার) এরই সঙ্গে চলছিল ‘হলুদ বাড়ির চিঠি’ নামের ডকু-ফিচার ছবির সঙ্গীত রচনার কাজ। এই ছবির শীর্ষ সঙ্গীতটি ইতোমধ্যেই মুক্তি পেয়েছে, এ বারে কাজ হবে নেপথ্য সঙ্গীত রচনার। এছাড়া, মাঝে শহর ছাড়া হয়েও ছিলাম বেশ অনেকগুলো দিন। মালায়ালম ভাষায় বিজ্ঞাপনের ছবি তৈরী করব ব’লে কেরালায় গিয়ে পড়েছিলাম দু ক্ষেপে – প্রথমে রেকি করতে, আর তার পরে শুটিং এবং পোস্ট প্রোডাকশন। মালায়ালম ছাড়াও তামিল, তেলুগু, কন্নড় এবং হিন্দিতে ডাবিং হলো সে ছবি। ওখানকার অভিনেতা, কলাকুশলী, টেকনিশিয়ানদের সাথে কাজ করলাম। সে এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। কী চমৎকার মানুষজন। কী চমৎকার, সুভদ্র আধুনিক সঙ্গীত ওঁদের। লক্ষ্য করার মত, যে সলিল চৌধুরী আধুনিক মালায়ালম ছায়াছবির সঙ্গীতে যে সুগভীর প্রভাব ফেলে এসেছিলেন, তার সাক্ষ্য তাঁরা আজও সগর্বে বহন ক’রে চলেছেন।

দ্বিতীয় কারণটার কথা এবারে বলি। এটা একেবারেই সাঙ্গীতিক ও প্রযুক্তিগত কারণ।

রবীন্দ্রনাথের গানগুলোর সাথে পিয়ানোর একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। বহু দিনের ইচ্ছে শুধু পিয়ানোর সাথে হারমোনিকা বাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করি। আর এই গানটা তো একেবারেই পিয়ানোর গান।

এদিকে আবার কয়েক মাস হ’ল আমার বাসায় একটি নতুন যন্ত্রের আবির্ভাব হয়েছে। ইনি একটি পিয়ানো। তবে অ্যাক্যুস্টিক পিয়ানো নন, ডিজিটাল পিয়ানো। ইয়ামাহা কোম্পানির তৈরী ক্লাভিনোভা পিয়ানো। চমৎকার বেজে থাকেন। কিন্তু আমি তাঁর যোগ্য নই। অশিক্ষিতের মত বাজাই।

এদিকে, আমি যে অর্কেস্ট্রা রচনা করার চেষ্টা করি, সেটা আজকাল করি কম্পিউটারে, কিউবেস ব’লে একটি চমৎকার DAW এর মাধ্যমে। পিয়ানোর যে টোন আমি এতদিন ব্যবহার ক’রে এসেছি, সেটি হলো ‘পিয়ানিসিমো’ নামের একটি VST। কিছুদিন যাবৎ সেই শব্দটি আর আমার ভালো লাগছে না। এবারে, ইয়ামাহার ক্লাভিনোভা যখন ঘরে এলেন; মাথায় নতুন আইডিয়া এলো, সেই টোনকে কিভাবে ব্যবহার করা যায়। কেননা এঁর ধ্বনি বৈশিষ্ট্য আরও অনেক গভীর এবং বেশি ভালো। এদিকে পিয়ানোতে যে লাইভ বাজাতে পারব, তেমন দক্ষতা আমার নেই। পিয়ানো তো অনেক পরের কথা, কোনও চাবিওয়ালা যন্ত্রই আমি কখনও শিখিনি। যে বাজনা মগজে বাজে, তাকে হাতে আনতে গেলে প্রোগ্রামিং ছাড়া গতি নেই। কাজেই কিউবেস ভরসা।

ভাবলাম কিউবেসে প্রোগ্রামিং ক’রে মিডি ফাইল বানিয়ে নেব, তারপর পেন ড্রাইভে ক’রে সেই মিডি আমার ডিজিটাল পিয়ানোতে গুঁজে দিলে সেই প্রোগ্রাম বেজে উঠবে ক্লাভিনোভা পিয়ানোর ধ্বনিতে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পিয়ানোও বেজে উঠলেন চমৎকার ভাবে; ঠিক যে রকমটি চাইছিলাম। কিন্তু সেই ধ্বনি রেকর্ড করতে গিয়ে ক’রে ফেললাম কিছু যান্ত্রিক এবং প্রযুক্তি গত ত্রুটি। খাদের শব্দ গেল ফেটে। চড়ার শব্দ শোনাতে লাগলো অস্বাভাবিক। সেই রেকর্ডিংয়ের ব্যবহার করা গেল না। মনটা খুঁত খুঁত রয়ে গেল। পরে আবার অন্য ভাবে পিয়ানো টাকে রেকর্ড করব ভেবে ফেলে রাখলাম এবং অন্যান্য সব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

তারপর সত্যি বলতে নানান কাজের চক্করে ভুলেই গেছিলাম এই গানটার কথা। এটা যে রেকর্ড ক’রে ফেলে রেখেছিলাম; মিক্স-টিক্স কিছু করা হয়নি, সে কথা এক্কেবারে মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল।

কাট টু গত সপ্তাহ। হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট ক’রে কথা হচ্ছিল হৈমন্তীর সাথে। হৈমন্তী কর্মকার, আমার স্নেহের পাত্রী; নিজে চমৎকার হারমোনিকা বাজিয়ে থাকেন। আমার খোঁজ নিচ্ছিলেন সেদিন। জিজ্ঞেস করছিলেন আমি নতুন কিছু রেকর্ড করেছি কিনা। আমি তাঁকে জানিয়েছিলাম যে অনেকদিন কিচ্ছু করা হচ্ছে না।

কী আশ্চর্য, সেদিন রাত্তিরেই কম্পিউটারে বসে আমার নজরে পড়ল সেই মিডি ফাইলটা। যেটা পেন ড্রাইভে করে পিয়ানোয় গুঁজেছিলাম।  মনে প’ড়ে গেল অসমাপ্ত কাজটার কথা।

ইতোমধ্যে বাড়ির রেকর্ডিং-সিস্টেমটাকে আর একটু বেটার করার জন্যে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি কিনেছি। কিন্তু কাজের চাপে সেগুলোকেও ব্যবহারোপযোগী ক’রে তুলতে পারিনি এখনো। এসেছে নতুন সফ্টওয়্যার। লজিক টেন। লজিকের কিছু নিজস্ব টোন আছে। সেগুলো অত্যন্ত সুন্দর। কী মনে হ’ল, লজিকের সাউন্ড ইঞ্জিনে সেই মিডি ফাইল টাকে টেনে এনে রেন্ডার করলাম। দিব্যি শোনাল। তারপর মিক্সিং করে ফেললাম সেই এপ্রিল মাসে রেকর্ড ক’রে রাখা হারমোনিকা ট্র্যাকটির সাথে। এই গানটায় যে পিয়ানোর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, সেটা লজিকের নিজস্ব গ্র্যান্ড পিয়ানোর ধ্বনি।

এখন কথা হচ্ছে, ক্যাপ্টেন স্পার্ক থাকলে তো RAXITও থাকবে! ইউটিউবে আপলোড করব, একটা লাগসই ভিডিও থাকবে না সে কি হয়? কাজেই তুলে ফেললাম একটা ভিডিও। গত ১৪ আগস্ট, রাত্তিরে। আমার ক্যামেরাটা সঙ্গে ছিল না। অগত্যা ফোনের ক্যামেরাই ব্যবহার করলাম। ব’লে রাখা ভালো, ছবিতে আমাকে যে পিয়ানো বাজাতে দেখা যাচ্ছে, সেটা নেহাতই ভিস্যুয়ালের প্রয়োজনে।

বসন্তের তাগিদে বাজিয়ে ফেলেছিলাম তখন; এখন কাজটা শেষ করার পরে মনে হলো একটু অন্যদের গাওয়াগুলো শুনি। আর কে কী রকম ভাবে ভেবেছেন গান টাকে। চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের এই গানটার সুর আমাকে কী বলছে; অন্যদেরই বা কী বলেছে।  শুনলাম। কণিকা বন্দোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সুবীর সেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রানী সেন আরও কয়েকজনের গাওয়া শুনলাম। যে ভদ্রলোকের গাওয়াটার সাথে নিজেকে সত্যি সত্যি রিলেট করতে পারলাম, তাঁর নাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাকিরাও চমৎকার গেয়েছেন, সুরে সুস্থির, সুতীক্ষ্ণ – কোনও কথা হবে না। কিন্তু গানটার জান টাকে ধরেছেন হেমন্তবাবু। ‘রোদন ভরা’ ব্যাপারটা যে এখানে দুঃখের নয় সেভাবে, একটা অন্তর্লীন বসন্তের সেলিব্রেশন আছে; ‘কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা সেজেছে পরিয়া নব পত্রালিকা’ সেটা একমাত্র তাঁর গায়কিতেই পাচ্ছি। লয় টাকে একটু বাড়িয়ে নিয়ে ভদ্রলোক ট্রাম্প করছেন; বিরহ-বেদনার রং হয়ে উঠছে কিংশুক-রক্তিম। ব্যথা যদি থেকে থাকে, তাতে আর যাই থাক করুণ-রস নেই মোটে।

‘কুঞ্জবনে মোর মুকুল যত আবরণবন্ধন ছিঁড়িতে চাহে’ – শুনছি আর নতুন ক’রে ভাবছি; রবীন্দ্রনাথ পুরুষ ছিলেন বটে।

কী আশ্চর্য দেখুন, ছেলেবেলা থেকে শোনা হেমন্ত বাবুর গানের এই স্পিরিট টাকেই আমি দেখলাম ধরতে চেয়েছি… নিজের অজান্তেই। চেয়েছি। হয়নি। যেমন হ’ল না এপ্রিল শেষের বসন্তের ডাকে সাড়া দেওয়া। ‘দেওয়া হল না যে আপনারে’ – কোনও দিনই কি পারলাম দিতে?

আমি এ প্রাণের রুদ্ধ দ্বারে – বারে বারেই এমন ব্যাকুল কর হেনে গেলাম – দরজা আর খুলল কই?  ভাবতে ভাবতে আজ ভরা বর্ষায় এই গানটার কাজ শেষ ক’রে এই লেখা লিখতে বসেছি।

#                  #                  #

সেদিন তুমি জিজ্ঞেস না করলে কাজটা শেষ করতাম কি? হয়ত করতাম কোনও দিন, হয়ত ভুলেই যেতাম। এই কাজটা তোমার জন্যেই থাকল হৈমন্তী।

২১ আগস্ট, রোববার ২০১৬
দমদম ক্যান্টনমেন্ট

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

  • Blog Stats

    • 19,879 hits
  • Enter your email address to subscribe to this blog and receive notifications of new posts by email.

    Join 22 other subscribers
%d bloggers like this: